এই গরমে ঘর শীতল করছে দেশে তৈরি এসি

দেশজুড়ে বয়ে চলা তাপপ্রবাহ এসির চাহিদা বাড়িয়েছে। ৯০ শতাংশ দেশে উৎপাদিত অথবা সংযোজিত।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বেশির ভাগ এলাকায় বয়ে যাচ্ছে তাপপ্রবাহ। গরমে স্বস্তির খোঁজে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) কিনছেন মানুষ। গতকাল সোমবার রাজধানীর গুলশানে ট্রান্সকম ডিজিটালের বিক্রয়কেন্দ্রে। মডেল: তানজিদা ও মাসুমছবি: প্রথম আলো

এপ্রিল মাসে এত দিন ধরে তাপপ্রবাহ ৭৬ বছরের মধ্যে দেখেনি দেশের মানুষ। গরমে শিশুদের নিয়ে চিন্তিত অভিভাবকেরা, প্রবীণেরা করছেন হাঁসফাঁস। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ ছুটছেন শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের (এসি) দোকানে।

সামর্থ্যবানেরা এসি তো কিনছেনই, কাউকে কাউকে সাধ্যের বাইরে গিয়ে এসি কিনতে হচ্ছে। বিশেষ দিক হলো, বাজারে বিক্রি হওয়া বেশির ভাগ এসি দেশে তৈরি অথবা সংযোজিত। সুপরিচিত বিদেশি ব্র্যান্ডের এসি যেমন দেশের কারখানায় তৈরি হয়, তেমনি দেশীয় ব্র্যান্ডও গড়ে উঠেছে।

এসি উৎপাদন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে, বর্তমানে এসির চাহিদার ৯০ শতাংশই দেশে উৎপাদিত অথবা সংযোজিত। বাজারে দেশীয় ব্র্যান্ড হলো ওয়ালটন, মার্সেল, যমুনা, মিনিস্টার, ট্রান্সটেক, ইলেকট্রা, এলিট, র‌্যাংগস, স্মার্ট, ভিশন, সেইফ ইত্যাদি। দেশে উৎপাদিত ও সংযোজিত বিদেশি ব্র্যান্ডের এসির মধ্যে রয়েছে গ্রি, সিঙ্গার, এসিসি, স্যামসাং, হায়ার, হিটাচি, মিডিয়া, এলজি, হাইসেন্স প্রভৃতি। শার্প, জেনারেল, প্যানাসনিক, ডাইকিন ইত্যাদি ব্র্যান্ডের এসিও দেশের বাজারে বিক্রি হয়। যেসব কোম্পানি এখন সংযোজন করছে, তারাও ভবিষ্যতে যন্ত্রাংশ উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে।

এর বাইরে চীন থেকে এসি আমদানি হয়। সেগুলোর সুপরিচিত কোনো ব্র্যান্ড নাম নেই।

দেশে এসি উৎপাদন ও সংযোজন কারখানা, এসি বিক্রি, স্থাপন ও মেরামত সেবা খাতে কাজ করেন বহু মানুষ। এ খাত থেকে সরকার প্রচুর রাজস্ব পায় বলে জানিয়েছে কোম্পানিগুলো। তারা বলছে, দেশে আগামী দিনগুলোতেও এসির বাজার বাড়বে। দেশ থেকে উৎপাদিত এসি এখন রপ্তানিও হচ্ছে।

এসি উৎপাদনের ক্ষেত্রে সরকারও নীতিসহায়তা দিয়েছে। দেশে উৎপাদন করলে দেওয়া হচ্ছে নানা ধরনের করছাড়। এতে বিদেশ থেকে আমদানি করে এসি বিক্রি করা ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে।

সার্বিকভাবে এসির বাজার নিয়ে মিনিস্টার–মাইওয়ান গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক খান প্রথম আলোকে বলেন, দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ছে। সেই সঙ্গে দেশেই উৎপাদনের কারণে এসির দাম কমেছে। সব মিলিয়ে এসির বাজার বাড়ছে।

বিক্রি কত

এসি উৎপাদন ও বিপণনকারীরা জানান, দেশে এখন বছরে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় লাখ ইউনিট এসি বিক্রি হয়। এর মধ্যে আবাসিক ভবনের এসি যেমন রয়েছে, তেমনি বাণিজ্যিক ভবন, অফিস–আদালত ও শিল্পে ব্যবহৃত এসি রয়েছে। করোনার আগে দেশে এসি বিক্রি বছরে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে বাড়ছিল। তবে করোনার মধ্যে এসির চাহিদা অনেক কমে যায়। তবে গত দুই বছরে বাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, চলতি বছর এসি বিক্রি বাড়বে প্রায় ৩০ শতাংশ।

দেশে গত বছর গ্রীষ্ম মৌসুমে এসি বিক্রি অনেক বেড়ে গিয়েছিল। এক পর্যায়ে চাহিদার তুলনায় এসির সংকটও দেখা দেয়। সেই অভিজ্ঞতা থেকে এ বছর আগেভাগেই বাড়তি উৎপাদনের প্রস্তুতি নিয়েছিল কোম্পানিগুলো। তারপরও চাহিদা অনুযায়ী এসি সরবরাহে হিমশিম খাচ্ছে তারা।

চলতি মৌসুমে প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি এসি উৎপাদন করেছে ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ। ওয়ালটনের চিফ বিজনেস অফিসার (এয়ার কন্ডিশনার) মো. তানভীর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমে তাদের ৫০ হাজারের বেশি এসি বিক্রি হয়েছে। চাহিদা থাকায় আরও বেশি এসি উৎপাদনে যাচ্ছেন তাঁরা।

এসি বিক্রি বৃদ্ধির চিত্রটি বোঝা যায় বিভিন্ন বিক্রয়কেন্দ্রে খোঁজ নিলে। রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় ইলেকট্রনিক পণ্যের ১০টির মতো বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। গত শনিবার বিক্রয়কেন্দ্রগুলো ঘুরে ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রত্যেকেরই লক্ষ্যের তুলনায় বেশি পরিমাণে এসি বিক্রি হয়েছে।

বাটারফ্লাইয়ের শেওড়াপাড়া বিক্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চাহিদা এত বেশি যে সরবরাহ করে কুলিয়ে উঠতে পারছি না।

দেশের কত ঘরে এসি রয়েছে তার একটি হিসাব পাওয়া যায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কাছ থেকে। সংস্থাটির স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস–২০২৩ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশের ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ পরিবারে (খানা) এসির ব্যবহার ছিল। ২০২৩ সালে এ হার বেড়ে দাঁড়ায় ২ দশমিক ২৮ শতাংশে। দেশে খানার সংখ্যা এখন ৪ কোটি ১০ লাখের মতো।

শুধু বিলাসিত নয়

অনেক পরিবারই এসি কিনতে একপ্রকার বাধ্য হচ্ছে। কারণ, গরম। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯০ শতাংশ এলাকা তীব্র তাপপ্রবাহের বিপদে রয়েছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল–পরিকল্পনা বিভাগের ‘ঢাকা নগরীর সবুজ এলাকা এবং এর রাজনৈতিক অর্থনীতি’ শিরোনামে এক গবেষণায় গত বছর উঠে এসেছে, ঢাকা মহানগরে ২০ ভাগ সবুজ এলাকা থাকা প্রয়োজন, সেখানে আছে সাড়ে ৮ শতাংশের কম।

প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ঠ সীমিত আয়ের মানুষও এখন ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা ব্যয় করে এসি কিনছেন। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বাসিন্দা শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভবনের সবচেয়ে ওপরের তলায় থাকি। গরমে টিকতে না পেরে এসি কিনেছি।’