শুল্কমুক্ত বাজার-সুবিধা ঠিক হবে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায়: ডব্লিউটিওর সম্মেলন

সম্মেলন শেষে যৌথ ঘোষণায় বলা হয়, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর তিন বছর উত্তরণকারী দেশগুলোর বিরুদ্ধে বিরোধ নিষ্পত্তি আইন প্রয়োগ শিথিল থাকবে। 

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ত্রয়োদশ মন্ত্রিপর্যায়ের বৈঠকে এক ফটোসেশনে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিরা। মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) আবুধাবিতেছবি: রয়টার্স

স্বল্পোন্নত বা এলডিসি থেকে উত্তরণের পরও উত্তরণকারী দেশগুলো তিন বছর শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পাবে। তবে এ সুবিধা যাওয়া ও দেওয়ার বিষয়টি আমদানি ও রপ্তানিকারক দেশ তথা দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর দাবি ছিল, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক, কিন্তু সেটি হয়নি। 

এ ছাড়া এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন টেকসই করতে কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রাখা হবে বলেও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বা ডব্লিউটিওর সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া এলডিসি উত্তরণের পর তিন বছর উত্তরণ ঘটানো দেশগুলোর বিরুদ্ধে বিরোধ নিষ্পত্তি আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সংযত আচরণ করা হবে বলেও সম্মেলনে জানানো হয়েছে। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন সূত্রে এই তথ্য পাওয়া গেছে। 

১ মার্চ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ত্রয়োদশ মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবিতে শেষ হয়েছে। ১ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মেলন শেষ হলেও অমীমাংসিত বিভিন্ন বিষয়ে ২ মার্চ সকাল পর্যন্ত আলোচনা চলেছে। এরপর সম্মেলনের যৌথ ঘোষণা দেওয়া হয়। যদিও যে আশা নিয়ে এই সম্মেলনে শুরু হয়েছিল, যৌথ ঘোষণায় তার খুব একটা প্রতিফলন ঘটেনি। গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত ছাড়াই সম্মেলন শেষ হয়েছে। 

সম্মেলনে অংশ নেওয়া বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এবারের সম্মেলনে বাংলাদেশ নিজ স্বার্থ রক্ষায় সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন আলোচনায় অংশ নিয়েছে। বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলো এলডিসি থেকে উত্তরণ টেকসই করার লক্ষ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধাসহ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে। এর আগে দোহা কর্মসূচিতে বলা হয়েছিল, এলডিসি থেকে উত্তরণের সময় দেশগুলোকে সাহায্য করা হবে। এসডিজির লক্ষ্যমাত্রাগুলোর মধ্যে ১৭ নম্বর লক্ষ্যমাত্রায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে উত্তরণকালীন সহায়তার কথা বলা হয়েছে। এবারের সম্মেলনে এলডিসি থেকে উত্তরণকে টেকসই করতে বাংলাদেশ উত্তরণের পরও নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা আরও কিছুদিন অব্যাহত রাখার কথা বলেছে। 

এবারের সম্মেলনে বেশ কিছু বিষয়ে ভারতের সঙ্গে উন্নত দেশগুলোর মতানৈক্য হয়েছে। ভারত মনে করছে, ১৯৯৮ সালে ই-কমার্সে শুল্ক আরোপের মুলতবির বিষয়টি এখন তুলে নেওয়া দরকার। ভারতের যুক্তি হলো, এই মুলতবির সিদ্ধান্তের কারণে ই-কমার্সের পণ্য আমদানিতে বিপুল পরিমাণ শুল্ক থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ভারত। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে ভারতের সঙ্গে একমত নয়। ফলে শেষমেশ সিদ্ধান্ত হয়েছে, চতুর্দশ মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক হওয়ার আগপর্যন্ত এই মুলতবি অব্যাহত থাকবে।

এ ছাড়া কৃষি ও মৎস্য খাতে ভারত যেসব দাবি তুলেছিল, সেসব বিষয়ে উন্নত দেশগুলো রাজি হয়নি, বিশেষ করে সরকারি পর্যায়ে কৃষিপণ্য কেনায় তারা যে ভর্তুকি দেয়, তা মোট কৃষি ভর্তুকির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত না করার দাবি ছিল ভারতের। 

মাছ ধরায় ভর্তুকির বিষয়টি নিয়ে প্রায় দুই দশক ধরে আলোচনা চলছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায়। ভর্তুকির জেরে বাড়তি মাছ ধরা এবং সে জন্য সমুদ্রের ভারসাম্য নষ্টের কথাও বলা হচ্ছিল বারবার। তাই দাবি উঠেছিল, এসব বন্ধ করা হোক। কিন্তু ভারত মৎস্য খাতে আরও ২৫ বছর ভর্তুকি দিতে চায়, এতেও রাজি হয়নি পশ্চিমা দেশগুলো। 

এবারের সম্মেলনে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সংস্কার নিয়েও ঐকমত্য হয়নি। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী একাধিক পক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে নির্বাচন। নির্বাচনের আগে এসব দেশের সরকার এমন কিছু করতে চাইছে না, যা দেশগুলোর ভোটের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে। ডব্লিউটিওর ত্রয়োদশ মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে বাণিজ্য সহজীকরণ, সেবা বাণিজ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে দেশগুলো পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা করেছে। 

বাংলাদেশ থেকে সম্মেলনে অংশ নেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। ‍তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এবার যেসব বিষয়ের নিষ্পত্তি হয়নি, সেসব বিষয়ের সমাধানে পৌঁছাতে বিভিন্ন ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে আলোচনা হবে। সে জন্য এখন বাংলাদেশের উচিত হবে এসব আলোচনায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা। 

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এবারের সম্মেলনে অনেক বিষয়ে মতানৈক্য থাকলেও শেষমেশ যে যৌথ ঘোষণা হয়েছে, তা ইতিবাচক। তা না হলে বহুপক্ষীয় বাণিজ্য ব্যবস্থার ওপর আস্থা কমে যেত।