টুপি: কোথায় তৈরি হয়, কত খরচ পড়ে, বিদেশি টুপির চাহিদাই-বা কেমন

রাজধানীর কেরানিগঞ্জের একটি কারখানায় টুপি তৈরির পর সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
প্রথম আলো

সারা বছরই টুপির কেনাবেচা হলেও পণ্যটি সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় ঈদের মৌসুমে। এ জন্য এ সময় ব্যস্ততাও বাড়ে টুপি তৈরির কারখানা আর পাইকারি ও খুচরা বাজারগুলোতে। তবে চলতি বছর বেচাকেনা এখনো আশানুরূপ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন টুপি ব্যবসায়ীরা।

ঈদের দিন নতুন পোশাকের সঙ্গে আবশ্যক উপকরণ হলো টুপি। বছরের অন্য সময়ে যা-ই হোক, ঈদের দিন ছোট-বড় সবাই মাথায় টুপি পরে ঈদগাহে উপস্থিত হন।

এসব টুপি দেশের কোথায় তৈরি হয়? দামদরইবা কেমন? আর আমদানি করা টুপিগুলো কোন দেশ থেকে আসে?

কেরানিগঞ্জের একটি কারখানায় টুপি তৈরি করছেন শ্রমিকেরা।
প্রথম আলো

টুপির বৃত্তান্ত জানতে গিয়েছিলাম রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর এলাকায়। সেখানকার আল কবির ক্যাপ কারখানায় ২০০৪ সাল থেকে টুপি তৈরি হয়। কারখানাটিতে বর্তমানে ৩০ জনের বেশি কর্মী কাজ করছেন। এই কারখানায় মূলত দুই ধরনের টুপি তৈরি হয়। এমব্রয়ডারি করা নকশি টুপি এবং ম্যানুয়াল বা হাতে নকশা ও সেলাই করা টুপি।  

প্রতিষ্ঠানটির বিপণন কর্মকর্তা মো. রাসেল জানান, পুরান ঢাকার ইসলামপুর থেকে কাপড় সংগ্রহ করে এনে তৈরি করা হয় এসব টুপি। রোজার ঈদের আগে প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ২০০ টুপি তৈরি করেন তাঁরা।

আল কবির ক্যাপের মতো প্রায় ৩০টি কারখানা রয়েছে কামরাঙ্গীরচর এলাকায়। এ ছাড়া সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে আরও দেড় শতাধিক কারখানা।

বাংলাদেশ টুপি প্রস্তুতকারক মালিক সমিতির সভাপতি মো. ফারুক আহমেদ খান জানান, তাঁদের সমিতির অধীনেই সারা দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে শতাধিক টুপির কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার কামরাঙ্গীরচর এলাকায় ৩০টির বেশি কারখানা আছে। এ ছাড়া কেরানীগঞ্জ, সাইনবোর্ড, মিরপুর, লালবাগ ও চকবাজারে বেশ কিছু কারখানা রয়েছে।

ঢাকার বাইরে বগুড়া, রংপুর, পঞ্চগড়, নওগাঁ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও ফেনীসহ কয়েকটি জেলায় টুপি তৈরি হয়। এসব জেলায় হাতে তৈরি টুপি বেশি পাওয়া যায়। স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি দেশে তৈরি টুপির একটা বড় অংশ রপ্তানিও হয়।

দেশে টুপির সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার রাজধানীর চকবাজার ও গুলিস্তানের খদ্দর মার্কেট। এ ছাড়া বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ মার্কেটে পাইকারি ও খুচরা উভয় পদ্ধতিতেই টুপি বিক্রি হয়। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজার ও বকশির হাট, সিলেটের হাজী কুদরত উল্লাহ মার্কেট ও হজরত শাহ জালাল (র.)-এর মাজার, কুমিল্লার কান্দিরপাড় ইত্যাদি স্থানে পাইকারি দামে টুপি বিক্রি হয়।

কেরানিগঞ্জের একটি কারখানায় সাজিয়ে রাখা হয়েছে টুপি।
প্রথম আলো

জমজমাট টুপির বাজার

টুপি প্রস্তুতকারক ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত দুই ঈদেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় টুপি বেচাকেনা হয়। কারখানাগুলোতে শবে বরাতের আগে থেকেই টুপি তৈরির জোর কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়, যা চলে মোটামুটি ২০ রোজা পর্যন্ত। এরপর খুচরা বাজারে টুপির বেচাকেনা বৃদ্ধি পায়।

রমজান মাসে রোজার শেষে পবিত্র ঈদুল ফিতর ছাড়া টুপি বিক্রির আরেক মৌসুম কোরবানির ঈদ। এ সময় সাধারণ মানুষ ছাড়াও হজযাত্রীরা নতুন টুপি কেনেন। এ ছাড়া বছরের শুরুর দিকে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ইজতেমার সময় এবং শীত মৌসুমে যখন বেশি পরিমাণে মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়, তখনো বেশ ভালো সংখ্যায় টুপি বিক্রি হয়।

টুপি তৈরির প্রতিষ্ঠান আল সাইফ ক্যাপের মালিক মো. সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি টুপি বিক্রি হয়। এ সময়ে মাঝারি মানের একটি কারখানা থেকে মাসে প্রায় এক লাখ টুপি বিক্রি হয়। আর বছরের অন্য মাসগুলোতে ২৫-৩০ হাজার টুপি তৈরি হয়।  

এমব্রয়ডারি মেশিনে টুপির নকশা করা হচ্ছে।
প্রথম আলো

দাম কেমন

টুপি প্রস্তুতকারকেরা জানান, কারখানা থেকে প্রতিটি এমব্রয়ডারি করা টুপি পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে ৩০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। আর সাধারণ নকশা করা প্রতিটি টুপি বিক্রি হয় ২৬ থেকে ৩০ টাকা দরে। এগুলোই খুচরা বাজারে গিয়ে ৮০ থেকে ১০০ টাকা বা তারও বেশি দামে বিক্রি করা হয় সাধারণ ক্রেতাদের কাছে।  

টুপিরও আছে নানা ধরন। বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটের খুচরা ব্যবসায়ী মফিজুল ইসলাম জানান, বাজারে হাজি টুপি (গোল টুপি), নেট টুপি, পাঁচ কল্লি টুপি ইত্যাদি নানা ধরনের টুপি কিনতে পাওয়া যায়। এর মধ্যে একটু শক্ত ধরনের গোল টুপিগুলো ১০০ থেকে শুরু করে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হয়।

অন্যদিকে নেট বা জাল আকৃতির টুপিগুলো ১০০ থেকে ৫০০ টাকা এবং পাঁচ কল্লি টুপি ৬০ থেকে ১০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। এ ছাড়া আমদানি করা বিশেষ নকশার কিছু টুপির দাম আরও বেশি হতে পারে বলে জানান এই বিক্রেতা।  

কাঁচামাল ও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় টুপির দাম কিছুটা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন টুপি প্রস্তুতকারকেরা। আল সাইফ ক্যাপের মালিক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, কাপড়ের দাম, বিদ্যুৎ ও গ্যাস খরচ, শ্রমিকের মজুরি ও অন্যান্য ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে গত বছরের চেয়ে উৎপাদন পর্যায়ে টুপিপ্রতি ৫ থেকে ৭ টাকা করে খরচ বেড়েছে।

বিদেশি টুপি

স্থানীয়ভাবে তৈরি টুপির পাশাপাশি আমদানি করা টুপির চাহিদাও রয়েছে ক্রেতাদের কাছে। বিশেষ করে ঢাকা ও অন্যান্য শহর এলাকায় শৌখিন অনেকে বিদেশি টুপি কেনেন। টুপি বিক্রেতারা জানিয়েছেন, চীন, তুরস্ক, পাকিস্তান, মিসর, থাইল্যান্ড, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইয়েমেন, লেবানন, মালয়েশিয়াসহ কয়েকটি দেশ থেকে টুপি আমদানি করা হয়। তবে সবচেয়ে বেশি টুপি আসে চীন থেকে।

কম দাম ও দেখতে চকচকে হওয়ায় বাজারে চীনে তৈরি টুপির চাহিদা বেশি। তবে যাঁরা একটু ভালো মানের অভিজাত টুপি চান, তাঁরা তুরস্ক, পাকিস্তান ও মিসরের টুপি কেনেন।

বাংলাদেশ টুপি প্রস্তুতকারক মালিক সমিতির সভাপতি মো. ফারুক আহমেদ খান জানান, সারা দেশে স্থানীয়ভাবে তৈরি টুপিই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। তবে ঢাকাসহ শহরাঞ্চলে আমদানি করা বিদেশি টুপির ভালো গ্রাহক রয়েছে।

ফারুক আহমেদ প্রথম আলোকে আরও বলেন, আগে সাধারণত মানুষ একবার টুপি কিনে দুই-তিন বছর ব্যবহার করতেন। কিন্তু টুপি এখন অনেকের কাছেই এখন শৌখিন পণ্য হয়ে গেছে। তাঁরা ভালো মানের একাধিক টুপি সংগ্রহে রাখেন।

‘বেচাকেনা এখনো জমেনি’

পাইকারি টুপি বিক্রেতারা জানিয়েছেন, চলতি বছর এখনো টুপির বেচাকেনা আশানুরূপ পর্যায়ে হচ্ছে না। টুপির পাইকারি মার্কেট চকবাজারে টুপি-আতর দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আমির হোসেন বলেন, মানুষ এখন নানাভাবে খরচ কমিয়ে চলছে। এ কারণে বেচাকেনা কিছুটা কম।

এ ছাড়া প্রয়োজনীয় সংখ্যক ঋণপত্র খুলতে না পারায় চাহিদা অনুসারে ভালো মানের বিদেশি টুপিও আমদানি করা যায়নি বলে জানান আমির হোসেন।

রোজার শেষ দিকে বেচাকেনা বাড়বে বলে প্রত্যাশা খুচরা ব্যবসায়ীদের। বায়তুল মোকাররম এফ ক্যাটাগরি টুপি, আতর, তজবিহ ও জায়নামাজ মার্কেট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মকবুল হোসেন ভুইয়া জানান, মূলত ২০ রোজার পর টুপির খুচরা বেচাকেনা বাড়বে। তখন মানুষ পাঞ্জাবি ও অন্যান্য ঈদ পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে টুপি কিনতে আসবেন।  

ঢাকার বাইরে টুপির উৎপাদন

বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় অনেক নারী সুই-সুতার বুননে টুপি তৈরি করেন। এসব টুপিকে জালি টুপি বলা হয়। সুতার কাজ ভেদে ২০ থেকে ২৫ ধরনের টুপি বানান তাঁরা। এতে মাথাপিছু প্রতিদিন ৩০০-৪০০ টাকা পর্যন্ত আয় হয় এসব নারীর।

বগুড়ার জালি টুপি ব্যবসায়ী অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক রিপন হোসাইন জানান, বগুড়ায় গড়ে প্রতিদিন দুই লাখ টুপি তৈরি হয়। প্রতিটি টুপির বাজারমূল্য ৩০ থেকে ৫০ টাকা। মোট উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশই বিদেশে রপ্তানি হয়।

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলায় আল ইকরা ক্যাপ ইন্ডাস্ট্রি নামে একটি প্রতিষ্ঠান টুপি তৈরি করে। কারখানাটিতে প্রতি মাসে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টুপি তৈরি করা হয়। খুচরা বাজারে এসব টুপি ১২০ থেকে শুরু করে ৫০০ টাকা পর্যন্ত দামে বিক্রি হয়। আগে এই ইউনিয়নে ছয়টি কারখানা ছিল। তবে পঞ্চগড়ের ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে, পুঁজির সংকট ও দক্ষ শ্রমিকের অভাবে পাঁচটি কারখানাই পরে বন্ধ হয়ে যায়।

নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর, নিয়ামতপুর, মান্দা ও নওগাঁ সদর উপজেলায় টুপি তৈরি হয়। রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার অধিকাংশ গ্রামেও টুপি তৈরি হয়। এসব টুপির বেশির ভাগ বিদেশে রপ্তানি হয়। রংপুরের টুপি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ওমান, কাতার, কুয়েত, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এসব টুপি যায়।