বছরে ৫০০ কোটি টাকার পোশাক আমদানি, বেশি আসে ৩ দেশ থেকে

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি পোশাক আমদানি হয় চীন থেকে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারত। তবে এ দুই দেশ থেকে আমদানির চেয়ে রপ্তানি বেশি।

বাংলাদেশে তৈরি পোশাক ইউরোপ-আমেরিকার নামীদামি ব্র্যান্ডের বিক্রয়কেন্দ্রে বিক্রি হয় প্রতিদিন। বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের অনেকেই গত এক দশকে দেশি চাহিদা মেটাতে পোশাকের ব্র্যান্ড গড়ে তুলেছেন। তারও আগে থেকে সুনামের সঙ্গে তৈরি পোশাকের ব্যবসা করছে বেশ কিছু ফ্যাশন ব্র্যান্ড ও বুটিক হাউস। তারপরও ভারত, পাকিস্তান ও চীন থেকে বছরে ৫০০ কোটি টাকার তৈরি পোশাক আমদানি হয় দেশে।

সারা বছর আমদানি হলেও ঈদুল ফিতরের আগে দেশে পোশাক আমদানি বেড়ে যায়। আর আমদানি হওয়া পোশাকের মধ্যে মেয়েদের লেহেঙ্গা, সালোয়ার কামিজ, শাড়ি, ওড়না ও ব্লাউজ বেশি। ছেলেদের পোশাকের মধ্যে টি-শার্ট, শার্ট, পাঞ্জাবি, জ্যাকেট, জিনস বেশি আমদানি হয়। আমদানির তালিকায় বাচ্চাদের পোশাকও আছে।

পোশাক আমদানির সঙ্গে যুক্ত একাধিক ব্যবসায়ী বলছেন, বর্তমানে নন–ব্র্যান্ডের পাশাপাশি অনেক ব্র্যান্ডও বিদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করে থাকে। আবার রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্যাম্পল বা নমুনা হিসেবেও পোশাক আমদানি করে। শুল্ক ও কর দিয়ে বৈধপথে বছরে ৫০০ কোটি টাকার পোশাক আমদানি হলেও লাগেজ পার্টি কিংবা অবৈধভাবে বিভিন্ন দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ পোশাক আসছে। ফলে আমদানি হওয়া তৈরি পোশাকের পরিমাণ আরও অনেক বেশি হবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যানুযায়ী, গত বছর বৈধপথে দেশে ২ কোটি ৩৫ লাখ পিস তৈরি পোশাক আমদানি হয়েছে। যার আর্থিক মূল্য প্রায় ৫০২ কোটি টাকা। অবশ্য ২০২২ সালে ২ কোটি ৬৩ লাখ পিস পোশাক আমদানি হয়েছিল। তখন খরচ হয়েছিল ৪৬৬ কোটি টাকা। মূলত গত বছর ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় পরিমাণে কম পোশাক আমদানি হলেও খরচ বেশি হয়েছে ব্যবসায়ীদের।

এবারের ঈদুল ফিতরের আগে গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৩ মাসে ৭৫ লাখ পিস পোশাক আমদানি হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে ২১৪ কোটি টাকা। এসব পোশাক বিশ্বের ৯০টির বেশি দেশ থেকে এসেছে। তবে ৯৬ শতাংশই এসেছে চীন, ভারত ও পাকিস্তান থেকে। ভারত থেকে মেয়েদের থ্রি–পিস, শাড়ি ও ছেলেদের পাঞ্জাবি বেশি আমদানি হয়। পাকিস্তান থেকে মেয়েদের থ্রি-পিস বেশি আসছে। আর চীন থেকে ছেলেদের টি-শার্ট, জার্সি, জ্যাকেট ইত্যাদি আমদানি হয় বেশি।

এনবিআরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত বছর আমদানি হওয়া প্রতিটি পোশাকের গড় দাম ছিল ২১৪ টাকা। তার সঙ্গে শুল্ক কর যোগ হয় গড়ে ১২৭ শতাংশ। তাতে দাম দাঁড়ায় প্রায় পৌনে ৫০০ টাকা।

দেশে আশির দশকের গোড়ার দিকে বুটিক শপের যাত্রা শুরু হয়। নব্বইয়ের দশকে এসে সংখ্যাটি বাড়তে থাকে। ২০০০ সালের পর পোশাক রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীরা ফ্যাশন হাউসের ব্যবসায় আসতে শুরু করেন। এই সংখ্যা গত এক দশকে বেশি বেড়েছে। বর্তমানে শীর্ষস্থানীয় ফ্যাশন ব্র্যান্ডের কয়েকটির মূল প্রতিষ্ঠান তৈরি পোশাক রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত। যদিও সামগ্রিকভাবে এখনো দেশে নন-ব্র্যান্ডের পোশাকই বেশি বিক্রি হয়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, নন-ব্র্যান্ডের পাশাপাশি ব্র্যান্ডগুলোও বর্তমানে বিভিন্ন দেশ থেকে পোশাক আমদানি করে।

অন্য অনেক প্রতিষ্ঠানের মতো বৈধভাবে টি–শার্ট, শার্ট, জিনস, জ্যাকেটসহ বিভিন্ন ধরনের তৈরি পোশাক আমদানি করে ইজি ফ্যাশন। সেসব পোশাক তাদের ৮৭টি বিক্রয়কেন্দ্রে খুচরা বিক্রি হয়। ইজি ফ্যাশনের মোট পোশাকের প্রায় ১০ শতাংশ আমদানি করা তৈরি পোশাক।

বিষয়টি নিশ্চিত করে ইজি ফ্যাশনের পরিচালক তৌহিদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্রেতাদের চাহিদা মেটাতেই চীন ও ভারত থেকে ছেলেদের পোশাক আমদানি করে থাকি আমরা। চীন থেকে টি–শার্ট ও জ্যাকেট এবং ভারত থেকে শার্ট ও জিনস নিয়ে আসি।’ তবে উচ্চ শুল্ক ও করের কারণে আমদানি করা পোশাকের খরচ বেশি বলে জানান তিনি।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ৪ হাজার ৭৩৯ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। এর মধ্যে ভারতে ৯২ কোটি ডলার, চীনে ৩৫ কোটি ডলার এবং পাকিস্তানে ২৮ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়।

ইপিবি ও এনবিআরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, পাকিস্তানে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের রপ্তানি কম হলেও আমদানির পরিমাণ বেশি। দেশি মুদ্রায় গত বছর পাকিস্তানে ৩০ কোটি টাকার (প্রতি ডলার ১০৮ দশমিক ২৪ টাকা হিসাবে) পোশাক রপ্তানি হয়। তার বিপরীতে গত বছর ১৪৪ কোটি টাকার পোশাক আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে মেয়েদের সালোয়ার কামিজই আমদানি হয়েছে ১৩১ কোটি টাকার। গত বছর পাকিস্তান থেকে আমদানি হওয়া পোশাকের ৯০ শতাংশ ছিল মেয়েদের পোশাক। এর বাইরে ছেলেদের কিছু জিনস প্যান্ট এসেছে দেশটি থেকে।

অন্যদিকে, চীন ও ভারত থেকে আমদানির তুলনায় রপ্তানি বেশি বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের। গত বছর ভারত থেকে বৈধপথে আমদানি হয় ১৬৪ কোটি টাকার তৈরি পোশাক। তার তুলনায় রপ্তানি প্রায় ৬১ গুণ বেশি। গত বছর ভারতে রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৯ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকার পোশাক। এদিকে গত বছর চীনের বাজারে প্রায় ৩ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকার বাংলাদেশি তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়। তার বিপরীতে ১৬৯ কোটি টাকার পোশাক আমদানি হয়েছে।

দেশি ফ্যাশন হাউসের আধিক্যের পাশাপাশি রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকের শক্ত ভিত্তি থাকার পরও বিদেশ থেকে পোশাক আমদানির বিষয়ে জানতে চাইলে রঙ বাংলাদেশের স্বত্বাধিকারী সৌমিক দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফ্যাশনশিল্পে কিছু জায়গায় আমাদের দুর্বলতা থাকায় বিদেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি হচ্ছে। যেমন ভারত থেকে যে ধরনের পোশাক আসছে, সেগুলো তৈরি করতে গেলে আমাদের উৎপাদন ব্যয় বেশি হচ্ছে। বিভিন্ন রকম সুযোগ-সুবিধা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের একধরনের দক্ষতা তৈরি হয়েছে। আমাদের দেশেও পরিকল্পনা নিয়ে এগোলে আমদানি কমানো সম্ভব। একই সঙ্গে দেশি পণ্য কেনার প্রতি সবার আগ্রহ থাকতে হবে।’