কম্বোডিয়ায় ইটভাটায় পুড়ছে ব্র্যান্ডের বর্জ্য, অ্যাডিডাস-ওয়ালমার্টসহ যাদের নাম এসেছে

অ্যাডিডাস, ওয়ালমার্টসহ অন্তত ১৯টি বৈশ্বিক ব্র্যান্ডের বর্জ্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ কম্বোডিয়ার বিভিন্ন ইটের ভাটায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্জ্য পোড়ানোর ফলে এসব ইটভাটার বেশ কিছু শ্রমিক অসুস্থ হয়েছেন। শ্রমিকেরা মাইগ্রেনের সমস্যা, নাক দিয়ে রক্ত পড়া ও অন্যান্য অসুস্থতার কথা নিয়মিতভাবে জানাচ্ছেন।

দ্য কম্বোডিয়ান লিগ ফর দ্য প্রমোশন অ্যান্ড ডিফেন্স অব হিউম্যান রাইটস (লিকাঢো) নামে কম্বোডিয়ার স্থানীয় একটি অধিকার গোষ্ঠীর প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল সোমবার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয় বলে রয়টার্সের খবরে জানানো হয়েছে।

গত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেন ও প্রতিবেশী কান্দাল প্রদেশে ২১টি ইট কারখানা পরিদর্শন করেন লিকাঢোর প্রতিনিধিরা। একই সঙ্গে এসব ইটভাটার বর্তমান ও সাবেক কর্মীদের সাক্ষাৎকারও নেওয়া হয়। যে তথ্য পাওয়া গেছে, তার ওপর ভিত্তি করেই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

লিকাঢোর প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২১টি কারখানার মধ্যে ৭টিতে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কাপড়, প্লাস্টিক, রাবারসহ বিভিন্ন পোশাক তৈরি থেকে পাওয়া বর্জ্য পোড়ানো হচ্ছে। মূলত জ্বালানি খরচ বাঁচাতেই ইট কারখানাগুলো পোশাকের বর্জ্য পোড়াচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এসব বর্জ্য পোড়ানোর কারণে শ্রমিকেরা কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তা–ও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। গবেষণার সময় দেওয়া সাক্ষাৎকারে কারখানাগুলোর বেশ কিছু কর্মী জানিয়েছেন, পোশাকের বর্জ্য পোড়ানোর কারণে তাঁদের মাথাব্যথা ও শ্বাসকষ্টের সমস্যা হয়েছে। আরেকজন নারী কর্মী বলেছেন, বর্জ্য পোড়ানোর কারণে তাঁর গর্ভাবস্থার সময় বিশেষভাবে অসুস্থ বোধ করেছিলেন।

এদিকে ইটভাটায় বর্জ্যের ব্যবহার নিয়ে জানতে চাইলে প্রাইমার্ক, লিডলসহ বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ড জানিয়েছে, তারা বিষয়টি তদন্ত করে দেখছে।

বর্জ্য পোড়ানো কতটা ঝুঁকিপূর্ণ

২০২০ সালে জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রকল্প (ইউএনডিপি) কম্বোডিয়ায় বর্জ্য পোড়ানোর দূষণ নিয়ে একটি অভ্যন্তরীণ সমীক্ষা করে। এতে কিছু পোশাক কারখানার বর্জ্য পোড়ানোর দহনযন্ত্র থেকে দূষণের হিসাব পরিমাপ করা হয়েছিল।

ইউএনডিপির সমীক্ষায় দেখা গেছে, পোশাকের বর্জ্য পোড়ানো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যদি দহনপ্রক্রিয়া সতর্কতার সঙ্গে না করা হয়, তাহলে বর্জ্য পোড়ানোর সময় মানুষের জন্য বিষাক্ত পদার্থ নির্গত হতে পারে। এ ছাড়া বর্জ্যের ছাইতেও উচ্চ মাত্রার দূষণকারীও পদার্থ থাকতে পারে। এমনকি এসব বিষাক্ত পদার্থের মধ্যে ডাই–অক্সিনের মতো উপকরণ রয়েছে, যা ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে। যদিও এ বিষয়ে রয়টার্সকে কোনো মন্তব্য জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে সংস্থাটি।

যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠান রয়্যাল হলওয়েতে বর্জ্য পোড়ানো নিয়ে ২০১৮ সালে পৃথক একটি গবেষণা করা হয়। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পোশাকের রং করা ও তা ছাপানোর সময় এতে প্রায়ই ক্লোরিন ব্লিচ, ফর্মালডিহাইড, অ্যামোনিয়াসহ বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান এবং পিভিসি ও রেজিনের মতো ভারী ধাতু ব্যবহার করা হয়। ফলে পরবর্তীকালে এসব পদার্থ থেকে দূষণের আশঙ্কা থাকে। যুক্তরাজ্যের গবেষকদের কাছে ইটভাটার শ্রমিকেরা নিয়মিত মাইগ্রেন, নাক দিয়ে রক্ত পড়া ও অন্যান্য অসুস্থতার কথা জানিয়েছেন।

যেসব ব্র্যান্ডের নাম এসেছে

লিকাঢোর প্রতিবেদনে যেসব বৈশ্বিক ব্র্যান্ডের নাম এসেছে, তার মধ্যে রয়েছে—অ্যাডিডাস, সিঅ্যান্ডএ, এলপিপির ক্রপ ও সিনসে, ডিজনি, গ্যাপ, ওল্ড নেভি, অ্যাথলেটা, কার্বন, কিয়াবি, লুলুলেমন অ্যাথলেটিকা, লিডল স্টিফটুং অ্যান্ড কোম্পানির লুপিলু, ওয়ালমার্টের নো বাউন্ডারিস, প্রাইমার্ক, রিবক, সুইটি, টিলি এন্ডিউরেবলস, আন্ডার আর্মর ও ভিনাস ফ্যাশন।

কম্বোডিয়ায় অ্যাডিডাসের ১৬টি সোর্সিং কারখানা রয়েছে। একটি সূত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, অনুমোদিত পদ্ধতির বাইরে গিয়ে ইটভাটায় বর্জ্য সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে কি না, তা দেখতে তদন্ত শুরু করেছে অ্যাডিডাস।

কম্বোডিয়ায় অ্যাডিডাসের পরিবেশ নীতিতে বলা আছে, তাদের কাছে পোশাক সরবরাহকারীদের সমস্ত বর্জ্যের অবশ্যই নিরাপদ ব্যবস্থাপনা করতে হবে। একটি অনুমোদিত ও নিয়ন্ত্রিত বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে পাঠানো কিংবা সরকার নিবন্ধিত কোনো বর্জ্য পুনর্ব্যবহার কেন্দ্রে পাঠানোর মাধ্যমে এসব বর্জ্য অপসারণ করা হবে। সুতরাং নিয়ম অনুসারে এসব বর্জ্য ইটভাটায় যাওয়ার কথা নয়।

আরেক বৈশ্বিক কোম্পানি লিডল বলেছে, তারা লিকাঢোর প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্যগুলো অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে নিয়েছে এবং তদন্ত শুরু করেছে। তবে এ বিষয়ে আর কোনো তথ্য তারা দিতে পারেনি।

অন্যদিকে টেক্সটাইল বর্জ্য ইটভাটায় পোড়ানোর বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ছিল না বলে জানিয়েছে এলপিপি। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, কম্বোডিয়ার যেসব এজেন্ট তাদের হয়ে ক্রয়াদেশ দেয়, তাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করেছে। এ ছাড়া ২০২৪ সালের প্রথম দিকে কম্বোডিয়ায় তাদের এজেন্ট ও কারখানাগুলোর জন্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপর একটি সচেতনতা দিবস পালনের পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছে এলপিপি।

আয়ারল্যান্ডের ব্র্যান্ড প্রাইমার্ক কম্বোডিয়ার ২০টি কারখানা থেকে পোশাক সংগ্রহ করে। এই ব্র্যান্ডও ইটভাটায় বর্জ্য পোড়ানোর বিষয়টি তদন্ত করছে বলে জানিয়েছে। টিলি এন্ডিউরেবলস বলেছে, শুধু নিরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া কারখানাগুলোর সঙ্গে তারা কাজ করছে। তবে লিকাঢোর গবেষণায় পাওয়া ফলাফলের বিষয়ে তারা ‘খুব উদ্বিগ্ন’।
এদিকে অন্যান্য ব্র্যান্ড মন্তব্যের জন্য রয়টার্সের অনুরোধের সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়নি। এ ছাড়া কম্বোডিয়ার পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও বর্জ্য সংগ্রহকারী কোম্পানি সারোম ট্রেডিংও মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেয়নি।