আরও দুটি চালকল কিনল আকিজ রিসোর্সেস
এই খাতে দেড় দশক ধরে বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগ করছে।
এখন সিটি, আকিজ, টিকে, এসিআই, প্রাণ, এরফান মোজাম্মেল ও রশীদ হচ্ছে চালের বড় সরবরাহকারী।
নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার রাজ্জাক মণ্ডল ১৯৮০ সালে পারিবারিকভাবে চালকলের ব্যবসা শুরু করেন। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে তিনি আগের চালকলগুলোর আধুনিকায়নের পাশাপাশি আধুনিক চালকলও প্রতিষ্ঠা করেন। সব মিলিয়ে তাঁর চালকলের সংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচ।
কিন্তু ব্যবসায়ে লোকসান দেখা দেওয়ায় ব্যাংকের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়েও তিনি ধারদেনায় জর্জরিত হয়ে পড়েন। তা থেকে রেহাই পেতে তিনি দুটি চালকল বিক্রি করে দেন। সেগুলো প্রায় ৮০ কোটি টাকায় কিনেছে আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান আকিজ রিসোর্সেস লিমিটেড।
এর আগে প্রায় ৩০০ কোটি টাকায় সজীব গ্রুপের হাশেম রাইস মিল কিনেছিল আকিজ রিসোর্সেস। ফলে তাদের তিনটি চালকলের মোট চাল উৎপাদনের ক্ষমতা প্রায় ১১ হাজার মেট্রিক টন। জানা গেছে, সামনে আরও চালকল কেনার পরিকল্পনা করছে আকিজ রিসোর্সেস। এভাবে ধীরে ধীরে চালের বাজারে বড় হয়ে উঠছে প্রতিষ্ঠানটি।
আকিজ রিসোর্সেস আগে সজীব গ্রুপের হাশেম রাইস মিল কিনেছিল। ফলে প্রতিষ্ঠানটির মাসিক চাল উৎপাদনের ক্ষমতা হয়েছে ১১ হাজার টন।
আকিজ রিসোর্সেস আকিজ গ্রুপ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পেয়েছে। পাশাপাশি নতুন কিছু প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছে। এখন আকিজ রিসোর্সেসের রয়েছে আকিজ ব্র্যান্ডের সিমেন্ট, স্টিল, চাল, আটা, মোটর, রাসায়নিক সার, শিপিংলাইন, পলি ফাইবার ও প্রযুক্তি খাতের ব্যবসা। এসবের কর্ণধার হলেন শেখ জসিম উদ্দিন।
আকিজ রিসোর্সেসের প্রধান স্ট্র্যাটেজিক কর্মকর্তা মিনহাজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা পুরোনো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মানুষের প্রধান খাদ্যপণ্যের সঙ্গে যুক্ত থাকতে চাই। দেশে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে আমরা উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যায়ে খাদ্যপণ্য পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত কাজ করতে চাই। এ জন্য তিনটি চালকল কেনা হয়েছে। এ ছাড়া খাদ্য ব্যবসায়ে আরও নিবিড়ভাবে যুক্ত হওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।’
যেভাবে চালকল অধিগ্রহণ
জানা গেছে, নওগাঁয় কেনা দুটি চালকলের মধ্যে একটি হলো রাবেয়া অটো রাইস মিল ও অপরটি কফিল অ্যান্ড রাজ্জাক অ্যাগ্রো লিমিটেড। নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলায় ৭৭০ শতাংশ জমির ওপর রাবেয়া অ্যাগ্রো প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৫ সালে। এর মাসিক উৎপাদনক্ষমতা প্রায় এক হাজার মেট্রিক টন। সাউথইস্ট ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে চালকলটি স্থাপন করেছিলেন রাজ্জাক মণ্ডল। চালকলটির ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা।
কফিল অ্যান্ড রাজ্জাক অ্যাগ্রো লিমিটেডও গড়ে তোলা হয় মহাদেবপুর উপজেলাতেই। ২০১৭ সালে প্রায় ৮৭০ শতাংশ জমির ওপর গড়ে তোলা এই চালকলের মাসিক চাল উৎপাদনের ক্ষমতা ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন। এতে অর্থায়ন করে শরিয়াহভিত্তিক স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। শেষ পর্যন্ত তা সুদসহ বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭ কোটি টাকা। চালকল দুটিতে সেদ্ধ, আধা সেদ্ধ ও আতপ চাল উৎপাদিত হয়।
দেশে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে আমরা উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যায়ে খাদ্যপণ্য পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত কাজ করতে চাই। এ জন্য তিনটি চালকল কেনা হয়েছে। এ ছাড়া খাদ্য ব্যবসায় আরও নিবিড়ভাবে যুক্ত হওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।মিনহাজ আহমেদ, প্রধান স্ট্র্যাটেজিক কর্মকর্তা, আকিজ রিসোর্সেস
চালকল দুটির মালিক রাজ্জাক মণ্ডলের সঙ্গে আকিজ রিসোর্সেসের চুক্তি হয়। এরপর সাউথইস্ট ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ঋণের দায়িত্ব নেয় আকিজ রিসোর্সেস। তবে মিল বিক্রি করে কোনো টাকা পাননি রাজ্জাক মণ্ডল। ব্যাংকের দেনা থেকে মুক্ত হয়েই যেন খুশি তিনি।
রাজ্জাক মণ্ডল সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার পাঁচটি চালকল ছিল। এসব মিল করতে ব্যাংকঋণ মিললেও চলতি মূলধন পাওয়া যায়নি। আবার ২০১৭ সালে ভারত থেকে দেশে চাল আমদানি শুরু হয়। দুটি মিলিয়ে লোকসানে পড়তে হয়েছে। সুদসহ ব্যাংকঋণ অনেক বেড়ে যায়। এ জন্য সব কটি চালকল বিক্রির চেষ্টা করছি। দুটি চালকল আকিজ রিসোর্সেস কিনে নিয়ে আমাকে ব্যাংকঋণ থেকে মুক্ত করেছে।’
স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কফিল অ্যান্ড রাজ্জাক অ্যাগ্রো আমাদের পুরোনো গ্রাহক। এটি আকিজ রিসোর্সেস কিনে নিয়েছে। তারা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনের পর প্রকল্পটি বুঝে নিয়েছে।’
এর আগে ২০২১ সালে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা দিয়ে সজীব গ্রুপের হাশেম রাইস মিলস কিনে নেয় আকিজ রিসোর্সেস। এই প্রতিষ্ঠানকে ছয়টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ দিয়েছিল, যা সুদে–আসলে বেড়ে দাঁড়ায় ৩০০ কোটি টাকা। এই ঋণের মূল আয়োজক ছিল প্রাইম ব্যাংক। অংশ নেওয়া অন্য ব্যাংকগুলো হচ্ছে ট্রাস্ট, বেসিক, ব্যাংক এশিয়া ও পূবালী। তাদের সঙ্গে রয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান সাবিনকো। ২০২১ সালে এসব ঋণের দায়িত্বসহ চালকলটি কিনে নেয় আকিজ রিসোর্সেস। এই চালকলের মাসিক উৎপাদন ক্ষমতা সাড়ে আট হাজার মেট্রিক টন।
চালের বাজার
গ্লোবাল ফুড আউটলুক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে চাল উৎপাদনে এখনো শীর্ষে রয়েছে চীন। গত বছর দেশটিতে উৎপাদিত হয়েছে ১৪ কোটি ২৮ লাখ টন চাল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সেই দেশে চাল উৎপাদন ৪ শতাংশ বেড়ে ১৪ কোটি ৩৪ লাখ টনে উন্নীত হতে পারে। এর পরের অবস্থানে রয়েছে ভারত।
গত বছর ভারতে চাল উৎপাদিত হয়েছে ১৩ কোটি ৮ লাখ টন, যা চলতি অর্থবছরে দশমিক ১ শতাংশ বেড়ে হতে পারে ১৩ কোটি ১০ লাখ টন। বিশ্বে চাল উৎপাদনে এখন তৃতীয় স্থানে আছে বাংলাদেশ, যেখানে গত অর্থবছরে চাল উৎপাদিত হয়েছে ৩ কোটি ৮৩ লাখ টন, যা চলতি অর্থবছরে ১ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়ে ৩ কোটি ৮৯ লাখ টনে দাঁড়াতে পারে।
দেশে চাল উৎপাদনের সিংহভাগই এখনো স্থানীয় চালকলমালিকদের হাতে। গত দেড় দশক ধরে অবশ্য বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোও এই খাতে বিনিয়োগ করছে। এর মধ্যে সিটি, আকিজ, টিকে, এসিআই, প্রাণ, মোজাম্মেল, এরফান ও রশীদ হচ্ছে চালের বড় সরবরাহকারী।