ব্যবসাবান্ধব পরিবেশই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা দেবে 

বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং বা ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সাত দিনব্যাপী বাংলাদেশ সপ্তাহ চলছে।

ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তৈরি পোশাকের রপ্তানি বাড়াতে টেকসই পোশাক উৎপাদনে জোর দিতে হবে। সরবরাহব্যবস্থার সর্বত্র তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। যাতে পোশাকে ব্যবহৃত সব উপাদানের বিষয়ে ক্রেতারা স্বচ্ছ ধারণা পান। পাশাপাশি পোশাকশ্রমিকদের দেখভাল করতে হবে। তা ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা দিতে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

ঢাকা অ্যাপারেল সামিট নামের আন্তর্জাতিক সম্মেলনের একটি কর্ম অধিবেশনে অংশ নেওয়া বিদেশি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা এসব কথা বলেন। রাজধানীর পূর্বাচলের ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় (আইসিসিবি) গতকাল মঙ্গলবার সকালে দুই দিনব্যাপী এই সম্মেলনের উদ্বোধন হয়েছে। অন্যদিকে আইসিসিবির একটি হলে গতকাল দুই দিনব্যাপী বাংলাদেশ ডেনিম এক্সপো শুরু হয়েছে। এ ছাড়া গত সোমবার থেকে চলছে তিন দিনব্যাপী ‘ঢাকা অ্যাপারেল এক্সপো’ নামের প্রদর্শনী।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা দেখছি, ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে বাংলাদেশ থেকে পয়সা নিয়ে পোশাকশিল্পের বিরুদ্ধে বিদেশে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। 
মো. শাহরিয়ার আলম, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী 

তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ পোশাকশিল্পে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং বা ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সাত দিনব্যাপী মেড ইন বাংলাদেশ উইক আয়োজন করেছে। এতে সহায়তা করছে বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জ (বিএই)। সাত দিনের এই আয়োজনের অংশ হিসেবে ঢাকা অ্যাপারেল সামিট হচ্ছে।

বিজিএমইএর সহসভাপতি মিরান আলীর সভাপতিত্বে ‘পোশাকশিল্পের পথনকশা: সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে’ শীর্ষক অধিবেশনে ইন্ডিটেক্সের টেকসইবিষয়ক প্রধান কর্মকর্তা ফ্রান্সিসকো জাভিয়ার লোসাডা মনট্রো টেকসই পোশাকশিল্প গড়তে চারটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উদ্ভাবনে জোর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে পোশাক তৈরিতে পুনর্ব্যবহারযোগ্য তন্তুর ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে। সরবরাহব্যবস্থার প্রতিটি ধাপ ডিজিটালাইজেশন করতে হবে। একই সঙ্গে স্বচ্ছতাও লাগবে। টেকসই উৎপাদনব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এর মাধ্যমে পানির অপচয় বন্ধ ও নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়বে।

ওয়ালমার্ট সোর্সিং বাংলাদেশের ডিরেক্টর অব অপারেশনস রিতা লোহানি বলেন,‘ আমরা কম দামে ক্রেতাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ পোশাক দেওয়ার বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। এ ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রাধিকার টেকসই পণ্য।’ তিনি বলেন, পোশাকের উৎপাদনব্যবস্থা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। এ জন্য শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়াতে হবে।

বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি কুতুবউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা এখন জ্বালানিসংকটের মধ্যে রয়েছি। সারা বিশ্বেই একই সমস্যা। ফলে আমাদের গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পানির ব্যবহার কমাতে উদ্যোগ নিতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ২০২০ সালে ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোম্পানির এক গবেষণায় দেখা যায়, ৬৭ শতাংশ ভোক্তা টেকসই পণ্য চান। আর ২০ শতাংশ ভোক্তা এ জন্য ব্র্যান্ডের উদ্যোগ চান। ইতিমধ্যে ইউরোপে প্রোডাক্ট পাসপোর্ট চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছে। তার মানে সরবরাহব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা লাগবে। সব মিলিয়ে সবাইকে অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে।

আরেক অধিবেশনে বিজিএমইএর পরিচালক নাভিদুল হক বলেন, বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়লেও পণ্য সরবরাহব্যবস্থা অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে ব্যয়বহুল। একই সঙ্গে সক্ষমতারও অভাব রয়েছে। কাস্টমসেও প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে নৌ, রেল ও সড়ক যোগাযোগ থাকলেও অধিকাংশ পণ্য আনা-নেওয়া হয় সড়কপথে। তবে নৌ বা রেলপথে পণ্য পরিবহন বাড়ানো গেলে খরচ কমানো যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এর আগে সেমিনারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা দেখছি, ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে বাংলাদেশ থেকে পয়সা নিয়ে পোশাকশিল্পের বিরুদ্ধে বিদেশে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। আবার বাংলাদেশ থেকে পয়সা নিয়ে বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করা হয় তৈরি পোশাক রপ্তানিতে জিএসপি বাতিলের জন্য। অতীতে এটা আপনারা দেখেছেন। আমার কাছে নতুন কিছু প্রমাণ আছে। এখন সমস্যাটা প্রকট আকার ধারণ করেছে। দেশ ও শিল্পের স্বার্থে তাদের কাজে বাধা দিতে হবে। অথবা তাদের কাছ থেকে ব্যবসা অন্যত্র স্থানান্তর করতে হবে।’ 

আগামী তিন মাসের মধ্যে গ্যাস সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, শিল্পকারখানা জ্বালানি, বিশেষ করে গ্যাস–সংকটে ভুগছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে গ্যাস সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কাজ করছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন, বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী ও শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, বর্তমান সভাপতি ফারুক হাসান। উপস্থিত ছিলেন সংগঠনটির সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান।

দুই দিনব্যাপী বাংলাদেশ ডেনিম এক্সপোতে এবার বাংলাদেশ, চীন, জার্মানি, ভারত, ইতালি, জাপান, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, স্পেন, তুরস্ক, ভিয়েতনাম, যুক্তরাষ্ট্র, সান মারিনো ও হংকংয়ের ৮৪টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। 

ডেনিম এক্সপোতে অংশ নেওয়া স্কয়ার ডেনিমের মহাব্যবস্থাপক সাঈদ আহমাদ চৌধুরী বললেন, ‘ডেনিমের ক্রয়াদেশ খুবই কম। বর্তমানে আমাদের কারখানার উৎপাদন সক্ষমতার ৮৫ শতাংশ ব্যবহার করা যাচ্ছে। গতবার এই সময়ে আমাদের সক্ষমতার ১৫০ শতাংশ ক্রয়াদেশ ছিল। বর্তমানে ১২০ শতাংশ ক্রয়াদেশ থাকলে তা সন্তোষজনক হতো।’