অর্থ উপদেষ্টার সামনে যত চ্যালেঞ্জ

দুই-তিন বছর আগেও দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলোর প্রশংসা করতেন অর্থনীতিবিদেরা। আর সেগুলোকে রাজনৈতিক সাফল্য হিসেবে দেখাতেন ক্ষমতাসীনেরা। অনেকে উচ্ছ্বাসও প্রকাশ করতেন।

কিন্তু দেড়-দুই বছর ধরে অর্থনীতির এসব ভালো সূচক খারাপ হয়েছে। কোভিডের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পরিবর্তে অর্থনীতি চাপে পড়ে যায়। যেন অর্থনীতির ‘ফোকলা দাঁত’ দেখা যাচ্ছে।

এখন আবার নতুন সরকার নতুন প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছে। তবে তাদের সামনে অর্থনীতির বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। চ্যালেঞ্জগুলো হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখা, রিজার্ভ সুসংহত করা, দেশি-বিদেশি ঋণের দায় শোধ, প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয়ের প্রবাহ বৃদ্ধি, ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত সংস্কার এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার।

গত কয়েক সপ্তাহে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংঘাত, প্রাণহানি—এসব সংকট অর্থনীতিকে আরও চাপের মধ্যে ফেলেছে। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর কারণে বিনিয়োগ কমতে পারে। থমকে যেতে পারে অর্থনীতি।

ইতিমধ্যে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তাঁর জন্য অর্থনীতির এসব পরিচিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করাই বড় চ্যালেঞ্জ।

 

উচ্চ মূল্যস্ফীতি

২০২২ সালের শুরুর দিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বাড়তে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে জাহাজভাড়াও বৃদ্ধি পায়। এরপর থেকে নিয়ন্ত্রণে থাকা মূল্যস্ফীতি বাগড়া দেয়। ফলে বাড়তে থাকে নিত্যপণ্যের দাম, আর মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী যাত্রা শুরু হয়। তৎকালীন সরকার মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিকে বহির্বিশ্বের কারণ হিসেবে উল্লেখ করত। আমদানি করা কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয়ভাবে পণ্য উৎপাদনের খরচও বৃদ্ধি পায়। এর ওপর বাজার সিন্ডিকেট, সরবরাহব্যবস্থায় চাঁদাবাজি—এ ধরনের সমস্যা তো আগে থেকেই ছিল।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় দেশে মূল্যস্ফীতি ৬ থেকে সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন তা ১০ শতাংশ ছুঁই ছুঁই করছে। গত এক বছরে দেশে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেশি খারাপ অবস্থায় রয়েছে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত ১২ মাসের মধ্যে ৭ মাসই খাদ্যমূল্যের স্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। পুরো বছরে কোনো মাসেই সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের নিচে নামেনি। সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ, যা অর্থবছরওয়ারি হিসাবে এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। 

মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম দিকে তেমন উদ্যোগ নেয়নি। ২০২৩ সাল থেকে সুদের হার বাড়ানোসহ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়, কিন্তু কাজে আসেনি। মূল্যস্ফীতি যেসব কারণে বৃদ্ধি পায়, সেগুলোতে হাত না দিয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে মানুষের ওপর চাপ যেন কম থাকে, সেদিকেই মনোযোগী ছিল সরকার। যেমন এক কোটি লোককে পরিবার কার্ড দেওয়া।

ব্যবসায়ীদের আস্থা আনা

নতুন অর্থ উপদেষ্টার অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের আস্থায় আনা। এক দশকের বেশি সময় ধরে বিনিয়োগে স্থবিরতা রয়েছে। জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগ এক জায়গায় আটকে আছে। ব্যবসা করার খরচ কমেনি। তাই অর্থ উপদেষ্টাকে বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং ব্যবসায়ের খরচ কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে, যা উদ্যোক্তাদের মধ্যে আস্থা ফেরাবে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও অবশ্য প্রয়োজন।

গত কয়েক সপ্তাহের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তায় ছোট এবং মাঝারি ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাঁদের সহায়তা দেওয়ার দাবি উঠেছে।

 

রিজার্ভ-সংকট ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি

অর্থনীতির অন্যতম বড় সংকট হলো ক্ষয়িষ্ণু রিজার্ভ। গত এক বছরে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত (রিজার্ভ) প্রায় ১ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের মতো কমেছে। রিজার্ভের পতন ঠেকিয়ে ডলারের জোগান বাড়াতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ঋণসহায়তা নিয়েছে সরকার। সর্বশেষ গত জুলাই মাসে আইএমএফের গণনাপদ্ধতি অনুসারে রিজার্ভের পরিমাণ কমে হয় ২ হাজার ৪৮ কোটি ডলার, যা এক বছর আগে ছিল ৩ হাজার কোটি ডলারের বেশি।

এদিকে ডলারের দামও অনেক দিন ধরে বাড়তি। ১১৮ টাকা দরে ডলার কিনে পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে। ফলে রিজার্ভের মজুত থেকে ডলার বেশি খরচ হচ্ছে।

রপ্তানি ও প্রবাস আয়ে গতি কম

ডলারের জোগানের অন্যতম উৎস রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় তেমন একটা বাড়েনি। গত জুলাই মাসে এর আগের ১০ মাসের তুলনায় সবচেয়ে কম প্রবাসী আয় এসেছে। রেকর্ডসংখ্যক জনশক্তি প্রবাসে গেলেও সেই তুলনায় রেমিট্যান্স আসেনি। তাই ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে প্রবাসী আয় পাঠানো ঠেকাতে হবে। এ জন্য ব্যাংকের আনুষ্ঠানিক দর ও খোলাবাজারের ডলারের দামের মধ্যে পার্থক্য কমাতে হবে।

সম্প্রতি রপ্তানি আয়ের হিসাব নিয়ে গরমিল ধরা পড়েছে। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের রপ্তানি আয়ে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে প্রায় ৯ বিলিয়ন বা ৯০০ কোটি ডলারের পার্থক্য ধরা পড়ে। প্রকৃত রপ্তানি আয় কত, তা ঠিক করে সব হিসাব-নিকাশ করতে হবে।

ঋণ শোধের চাপ বেশি, শুল্ক-কর আদায় বৃদ্ধি

সরকারের খরচের অন্যতম বড় উৎস শুল্ক ও কর আদায়। দেশি-বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে। এখনো বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশের নিচে। বিশ্বের সবচেয়ে কম কর-জিডিপির দেশগুলোর একটি হলো বাংলাদেশ। কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আদায় না হওয়ায় সরকারকে বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ পরিমাণ অর্থ জোগানের জন্য দেশি-বিদেশি ঋণ নিতে হয়।

গত অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) শুল্ক-কর আদায়ে ঘাটতি ছিল প্রায় সাড়ে ২৭ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে গতবার বিদেশি ঋণ শোধ করতে হয়েছে প্রায় ৩৩৬ কোটি ডলার। বিদেশি ঋণ হিসেবে যে পরিমাণ অর্থ আসে, এর এক-তৃতীয়াংশ চলে যায় পরিশোধে।

অগ্রাধিকার সংস্কার

বড় বড় অনেক ব্যবসায়ী নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে তা ফেরত দেননি। ব্যাংক খাতের বড় বিষফোড়া তাঁদের এই খেলাপি ঋণ, যা বেড়ে এখন রেকর্ড ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকায় উঠেছে। গত দেড় দশকে একাধিক ব্যাংক জোর করে দখলে নিয়েছে এস আলম গ্রুপসহ একাধিক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবারের সদস্য দীর্ঘ সময় বহাল রাখার নীতিও চালু আছে। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ রয়েছে। পুরো ব্যাংক খাতের সংস্কারে একটি কমিশন গঠনের দাবি দীর্ঘদিনের। এ ছাড়া পুঁজিবাজার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, রাজস্ব খাত, প্রকল্প বাস্তবায়নসহ অর্থনীতির প্রায় সব খাতেই সংস্কার প্রয়োজন।