ছয় মাসে এক টাকাও দেশে ফেরত আসেনি

প্রতীকী ছবি

বিদেশে পাচার করা টাকা কেউই দেশে ফেরত আনেননি গত ছয় মাসে। সরকার ৭ শতাংশ কর দিয়ে পাচারের টাকা দেশে আনার সুযোগ দিলেও কোনো সাড়া মেলেনি। এমনকি বিদেশে বৈধভাবে রাখা টাকাও দেশে ফেরত আসেনি। তবু আশা ছাড়ছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অবশ্য বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী এই সুযোগ নিতে পারেন বলে এনবিআরের কর গোয়েন্দারা জানিয়েছেন। তাঁরা বলেন, বিদেশে যেসব ব্যবসায়ীর নামে-বেনামে বিনিয়োগ আছে, তাঁদের অনেকেই এই সুযোগ নিতে পারেন।

যাঁদের অর্থ বিদেশে আটকে আছে, তাঁদের অনেকেই এখন সুযোগটি নিতে আগ্রহী।  
এনবিআরের আয়কর বিভাগ সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে কেউ পাচার করা টাকা দেশে এনেছেন, এমন তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি এনবিআর। তবে সূত্রগুলো বলছে, এ ক্ষেত্রে কোনো সাড়া নেই।

চলতি অর্থবছরে বাজেটের বড় চমক ছিল বিদেশে পাচার করা টাকা ফেরত আনার সুযোগ দেওয়া। তখন নীতিনির্ধারকেরা আশা করেছিলেন, এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে অনেকেই দেশে টাকা ফেরত আনবেন। কিন্তু প্রথম ছয় মাসে এমন কোনো করদাতার দেখা পায়নি এনবিআর।

গত বছরের ১ জুলাই থেকে শুরু সুযোগটি ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত কাজে লাগানো যাবে। এই সুযোগ নিলে এনবিআরসহ অন্য কোনো সংস্থা এই বিষয়ে প্রশ্ন করবে না। তবে বিদেশে সম্পদ বা অর্থ পাচারের প্রমাণ পাওয়া গেলে শাস্তি হিসেবে সমপরিমাণ অর্থ জরিমানা করার ক্ষমতা কর কর্মকর্তাদের দেওয়া হয়েছে। পরের অংশটিই এখন পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে বলে এনবিআরের কর্মকর্তারা মনে করেন। সংস্থাটির কর গোয়েন্দাদের একটি দল এখন কারা অর্থ পাচার করেছেন, তা নিয়ে কাজ করছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে তারা সভা করেছে।

সরকারের ঘনিষ্ঠরাই বিভিন্ন সময়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন। সরকার চাইলেই এসব ব্যক্তিদের টাকা পাচারের প্রমাণসহ তথ্য খুঁজে বের করতে পারে। তাঁরা সমাজের চিহ্নিত ব্যক্তি। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে ১০-২০ হাজার কোটি টাকা ফেরত আনা সম্ভব
—     আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পিআরআই।

এনবিআরের সূত্রগুলো বলছে, বিদেশে পাচার করা টাকা দেশে ফেরত আনার সুযোগটি কার্যকর হয় গত জুলাই মাস থেকে। এরই মধ্যে কানাডায় নিয়মিত ‘আসা-যাওয়া’ করা একজন বাংলাদেশি দেশে টাকা আনতে চেয়েছেন। তিনি এ নিয়ে পরামর্শ চাইলে তাঁকে আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলতে বলেন এনবিআরের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ওই ব্যক্তি ঢাকায় প্লট বিক্রি করে হুন্ডিতে টাকা পাচার করেছিলেন। কিন্তু তিনি এখন কিছু অর্থ বাংলাদেশে এনে একটি ফ্ল্যাট কিনতে চান। আইনজীবী ভবিষ্যতে নানা হয়রানির ভয় দেখান। সে জন্য ওই ব্যক্তি আর টাকা ফেরত আনতে আর আগ্রহ দেখাননি।

ব্যাংকের মালিকানার সঙ্গে যুক্ত এবং জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ রয়েছে–এমন দুজন ব্যবসায়ীও এখন দেশে টাকা ফেরত আনতে আগ্রহী। আলাদা আলাদাভাবে তারা এ আগ্রহ দেখিয়েছেন। বিদেশে তাঁদের বড় অঙ্কের বিনিয়োগ আছে। কীভাবে টাকা আনা যাবে, তা নিয়ে ইতিমধ্যে এনবিআরসহ সরকারপক্ষ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে নানা মাধ্যমে তাঁরা আলোচনা করেছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাবেক একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বর্তমানে পার্শ্ববর্তী দেশে আছেন। তাঁর পাচার করা টাকা দেশে ফেরত আনার বিষয়ে এখন কথাবার্তা চলছে।

সূত্রগুলো বলছে, আরেকটি শ্রেণি আছে, যারা বিভিন্ন সময়ে নগদ অর্থ বিদেশে নিয়েছে। কিন্তু দুবাই, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে অর্থ আটকে গেছে। তাদের অনেকেই এখন দেশে অর্থ ফেরত আনতে আগ্রহী।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের ঘনিষ্ঠরাই বিভিন্ন সময়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন। সরকার চাইলেই এসব ব্যক্তির টাকা পাচারের প্রমাণসহ তথ্য খুঁজে বের করতে পারে। তাঁরা সমাজের চিহ্নিত ব্যক্তি। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে ১০-২০ হাজার কোটি টাকা ফেরত আনা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, আরেক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ আমলা, ব্যবসায়ী আছেন, যাঁরা বিভিন্ন কৌশলে বিদেশে টাকা পাচার করেছেন। তাঁরা অর্থ নিরাপদ স্থানে নিয়ে গেছেন। অর্থ ফেরত আনবেন না তাঁরা।’  

কেন আগ্রহী নয়

আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত অর্থ ফেরত আনার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এই সময়ে কেউ অর্থ ফেরত আনলে তাঁকে সরকারের কোনো সংস্থাই প্রশ্ন করবে না। কিন্তু ৩০ জুনের পর (মেয়াদ শেষে) প্রশ্ন করা হবে কি না, তা পরিষ্কার করা হয়নি। এ কারণে অনেকে অর্থ আনতে উৎসাহিত হচ্ছেন না বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এ ছাড়া ফেরত আনার তালিকা প্রকাশ হয়ে গেলেও সামাজিকভাবে মর্যাদাহানির শঙ্কা আছে তাঁদের।

বিদেশ থেকে অর্থ ফেরত আনতে এ পর্যন্ত ভারত, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৭টি দেশ সুযোগ দিয়েছে। এতে শুধু ইন্দোনেশিয়া ছাড়া অন্য কোনো দেশ তেমন একটা সফল হয়নি।

এনবিআরের একাধিক আয়কর কর্মকর্তা জানান, মেয়াদের শেষ দিকে সাধারণত এই ধরনের সুযোগ বেশি নেন করদাতারা। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না বলে তাঁরা মনে করেন।

বাংলাদেশের বাইরে যেকোনো রূপে গচ্ছিত অপ্রদর্শিত অর্থ ৭ শতাংশ কর দিয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে বৈধভাবে দেশে এনে আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করা যাবে। তবে অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে বিভিন্ন দেশে নানা বিধিনিষেধও আছে। এসব বিধিনিষেধের কারণে অনেকেই উৎসাহী হন না।