উৎপাদনে ছোটরা, দাম নির্ধারণে বড়রা 

ক্ষুদ্র খামারিরা এখন টিকে থাকার জন্য মুরগির বাচ্চা ও পোলট্রি খাদ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের সরাসরি পদক্ষেপ আশা করেন।

মুরগি
প্রতীকী ছবি: রয়টার্স

বাজারব্যবস্থায় শৃঙ্খলার অভাবে মুরগির দাম এখন ওঠানামার মধ্যে আছে। এ ক্ষেত্রে, অর্থাৎ দাম নির্ধারণে ক্ষুদ্র খামারিদের কিছু করার থাকে না। করপোরেট প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় ডিলার ও মধ্যস্বত্বভোগী এবং ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের বড় পাইকারেরাই দাম নির্ধারণ করেন। ফলে উৎপাদন খরচের সঙ্গে বাজারমূল্যের সামঞ্জস্য থাকে না। এতে ক্ষতির মুখে পড়ছেন ছোট খামারিরা। 

স্থানীয় ডিলার ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর কন্ট্র্যাক্ট ফার্মিংয়ের মাধ্যমে চলছে ছোট খামারিদের মুরগি পালনের কাজ। এতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে দাদন প্রথা। ফলে সংকট তৈরি হয়েছে দেশের পোলট্রি খাতে। ছোট খামারিদের অভিযোগ, মুরগির দাম নির্ধারণে করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও ডিলারদের পাশাপাশি স্থানীয় মধ্যস্বত্বভোগী এবং ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের বড় পাইকারদেরও বড় ভূমিকা থাকে। এই চার পক্ষ কখনো পরস্পরের যোগসাজশে বা কখনো আবার সিন্ডিকেট করে মুরগির দাম নির্ধারণ করে। তারাই ছোটদের মুনাফা খেয়ে ফেলে। যে কারণে খামারিদের লাভ হয় কম। 

বর্তমানে যে অবস্থা চলছে, তাতে ক্রেতাদের জন্য স্বস্তি যেমন দরকার, তেমনি খামারিদেরও টিকিয়ে রাখতে হবে। কৃষকদের যেমন নানা প্রণোদনা দেওয়া হয়, তেমনি ক্ষুদ্র খামারিদেরও টিকিয়ে রাখার জন্য শক্তিশালী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
এম আবু ইউসুফ, নির্বাহী পরিচালক, র‌্যাপিড 

ক্ষুদ্র খামারিরা এটাও বলছেন যে ডিলাররা যদি বাকিতে পণ্য না দিতেন, তাহলে তাঁরা উৎপাদনে টিকে থাকতে পারতেন না। কারণ, গত কয়েক মাসে মুরগির বাজারে অস্বাভাবিক অবস্থার কারণে অনেক ব্যবসায়ী মোটা অঙ্কের ক্ষতিতে পড়েছেন। এখন তাঁদের ব্যবসায়ে ফিরতে হলে ডিলারদের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। এর মানে, উৎপাদিত মুরগি ডিলারদের কাছেই বিক্রি করতে হবে। এতে ক্ষুদ্র খামারিরা উভয় সংকটে পড়েছেন।

সরেজমিনে গত সপ্তাহে নরসিংদী জেলার ইটাখোলা ও মরজাল এলাকায় গিয়ে ক্ষুদ্র খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্ষুদ্র খামারিরা মুরগির বাচ্চা পালন থেকে শুরু করে বাজারে মুরগি বিক্রি করা পর্যন্ত নানাভাবে শোষণের শিকার হচ্ছেন। যেমন তাঁদের নিজস্ব বিনিয়োগ কম থাকায় স্থানীয় ডিলারদের কাছ থেকে মুরগির বাচ্চা, খাবার ও ওষুধ বাকিতে বাড়তি দামে কিনতে হয়। সে ক্ষেত্রে শর্ত থাকে, ডিলারদের কাছেই মুরগি বিক্রি করতে হবে। এই শর্ত কাজে লাগিয়েই ডিলাররা নিজেদের ইচ্ছেমতো বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ করেন এবং নিজেদের পাওনা টাকা কেটে রাখেন। এরপরই কেবল খামারিরা লাভের কথা ভাবতে পারেন। 

মরজাল এলাকার খামারি খাজাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বছর দশেকের ওপরে আমি এই ব্যবসায়ে আছি। এ পর্যন্ত ৩০ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। সম্প্রতি ব্যবসায় টিকে থাকার জন্য স্থানীয় একজন ডিলারের থেকে খাবার ও ওষুধ নিয়ে মুরগি উঠিয়েছি। শর্ত হচ্ছে, বিক্রির সময় এই মুরগি তাঁকেই দিতে হবে। এর বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। কারণ, আমার কোনো বিনিয়োগ নেই।’

রাজধানীর রায়েরবাজার থেকে পাইকারিভাবে মুরগি কেজিপ্রতি ৩৪০ টাকা দরে কিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ৩৫০ টাকা দরে বিক্রি করবেন এই খুচরা ব্যবসায়ী। সায়েন্স ল্যাবরেটরি, ঢাকা, ৩ মে
ছবি: জাহিদুল করিম

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যে শুধু ডিলারদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছেন তা নয়, বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানও অফিস খুলে ‘কন্ট্রাক্ট ফার্মিং’-এর নামে ডিলারদের মতো সুবিধা দিচ্ছে। তারাও চুক্তি অনুযায়ী খামারিদের মুরগির বাচ্চা, খাবার ও ওষুধ সরবরাহ করে। বাচ্চাগুলো যখন মুরগি হয়ে ওঠে, তখন সেগুলো ‘বাজারদরে’ কোম্পানিগুলো নিয়ে যায়, যেমনটা ডিলাররা করেন। তাতে লাভের বড় অংশই কোম্পানি ও ডিলারদের পকেটে চলে যায়। খামারি পান ‘গ্রোয়িং চার্জ’, অর্থাৎ মুরগির বাচ্চা বড় করা বাবদ কিছু মজুরি।

মরজাল বাজারের ডিলার আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আগে সাধারণ দোকানদারের মতো ব্যবসা করতাম। খামারিরা বড় ক্ষতির শিকার হওয়ার পর বাকিতে পণ্য চাইতেন। এরপর নিরাপত্তা বিবেচনায় মুরগি আমার কাছে বিক্রি করার শর্তে খামারিদের পণ্য দিতে শুরু করি। এখন ব্যবসাটা এভাবেই চলছে।’ 

জয়পুরহাটের পোলট্রি উদ্যোক্তা মিসবাহ মারফি নানামুখী চাপের কারণে খামার বন্ধ করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত নভেম্বরে যখন বাজারটা একটু ভালো যাচ্ছিল, তখন আমি বিনিয়োগ বাড়াই। ঠিক সেই সময়েই বাজারে মুরগির দাম কমে আসে। এ জন্য আমি আর মুরগি ওঠাতে চাই না।’

ক্ষুদ্র খামারিরা বলেন, ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার দাম গত মার্চ-এপ্রিল মাসে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। তাতে প্রতিটি মুরগির বাচ্চা ৮০ টাকার ওপরে কিনতে হয়, যা সাধারণত ৩০ থেকে ৪০ টাকার মধ্যে থাকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতে পোলট্রি খাদ্যের কাঁচামাল ভুট্টা ও সয়ামিলের দাম বাড়লেও সাম্প্রতিক সময়ে কমতে শুরু করেছে। দেশেও এবার ভুট্টার ভালো ফলন হয়েছে। এতে পোলট্রি খাদ্যের দাম কমবে, এমন আশায় আছেন তাঁরা। 

এ ব্যাপারে ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মো. আহসানুজ্জামান বলেন, ইতিমধ্যে খাদ্যের দাম এক দফা সমন্বয় হয়েছে। আর নতুন আমদানি ঋণপত্রের (এলসি) মালামাল দেশে এলে খাদ্যের দাম আরও কিছুটা কমবে। তখন বাজারে অস্থিরতা কমে আসবে। এতে খামারি থেকে খাদ্য ব্যবসায়ী—সবার জন্য সুবিধা হবে বলে মনে করেন তিনি। 

এ পর্যন্ত ৩০ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। সম্প্রতি ব্যবসায় টিকে থাকার জন্য স্থানীয় একজন ডিলারের থেকে খাবার ও ওষুধ নিয়ে মুরগি উঠিয়েছি। শর্ত হচ্ছে, বিক্রির সময় এই মুরগি তাঁকেই দিতে হবে। এর বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। 
খাজাল উদ্দিন, খামারি, মরজাল এলাকা, নরসিংদী 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশের পোলট্রি ও গবাদিপশু পালন খাতে গত ডিসেম্বরের শেষে মোট ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এই পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা; অর্থাৎ চার বছরে দেশের পোলট্রি ও পশুপালনে বিনিয়োগ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। 

বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে মুরগির খামার আছে ৮০ হাজার থেকে ৯০ হাজার। করোনার আগে সংখ্যাটি ছিল ১ লাখ ১০ হাজারের ওপর। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দেশে প্রতিদিন ৪ কোটির বেশি ডিম ও ৩ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন মুরগির মাংস উৎপাদিত হয়। পোলট্রি খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান হয়েছে ৬০ লাখ লোকের, বাজারের আকার ৪০ হাজার কোটি টাকার ওপরে। 

 গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‌্যাপিড) নির্বাহী পরিচালক এম আবু ইউসুফ প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে যে অবস্থা চলছে, তাতে ক্রেতাদের জন্য স্বস্তি যেমন দরকার, তেমনি খামারিদেরও টিকিয়ে রাখতে হবে। কৃষকদের যেমন নানা প্রণোদনা দেওয়া হয়, তেমনি ক্ষুদ্র খামারিদেরও টিকিয়ে রাখার জন্য শক্তিশালী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।