ভারত চিনি রপ্তানি বন্ধ করলে কী প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে

চিনি
ফাইল ছবি

আগামী অক্টোবরে শুরু হওয়া নতুন মৌসুমে ভারত চিনি রপ্তানি বন্ধের পরিকল্পনা করছে। বৃষ্টির অভাবে আখের ফলন কমে যাওয়ায় দেশটি এ রকম পরিকল্পনা করছে বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

ভারত তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে চিনি আমদানিতে বাংলাদেশের খরচ বেড়ে যাবে। তবে এ নিয়ে দেশের আমদানিকারকদের কেউ কেউ অবশ্য উদ্বিগ্ন নন। তাঁরা বলছেন, ভারতের চিনি রপ্তানি বন্ধের খবরটি উদ্বেগের, তাতে খুব দুশ্চিন্তার কিছু নেই। কারণ, অন্য দেশের চিনি পাওয়া যাবে। সরকার ঋণপত্র (এলসি) খোলায় সুবিধা ও শুল্কহারে ছাড় দিলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির প্রভাব কমবে।

ব্রাজিলের পরই ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম চিনি রপ্তানিকারক দেশ। ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০২২–২৩ (এপ্রিল–মার্চ) মৌসুমে ৫৮ লাখ টন অপরিশোধিত চিনি রপ্তানি করেছে দেশটি, পরিশোধিত চিনি রপ্তানি করেছে প্রায় ৫৫ লাখ টন। বিশ্বের ৮১টি দেশ ভারতীয় চিনি কিনেছে (যারা ন্যূনতম এক হাজার টন নিয়েছে, তারাসহ)। তবে ভারতের অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে বাংলাদেশ ছিল শীর্ষে।

ভারতীয় চিনি রপ্তানি বন্ধ হলে ৮১টি দেশ চিনি আমদানির জন্য বিকল্প বাজার খুঁজবে। তাতে বিশ্ববাজারে চিনির চাহিদায় বাড়তি চাপ তৈরি হবে। এতে গত বছর থেকে ঊর্ধ্বমুখী থাকা চিনির দাম আবারও অস্থিতিশীল হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। ভারত রপ্তানি বন্ধের পরিকল্পনা করছে, এমন খবর প্রকাশের কারণে গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডে চিনির দাম শুরুতে আড়াই শতাংশ বেড়ে যায়। অবশ্য পরে তা কমে আসে।

ভারত রপ্তানি বন্ধ করলে বিশ্ববাজারে চিনির দাম বাড়তে পারে। তাতে দেশে আমদানি ও সরবরাহ নিয়ে খুব সমস্যা হবে না। কারণ, অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা যাবে। তবে এ জন্য চিনি আমদানির ঋণপত্র খুলতে যাতে কোনো সমস্যা না হয়, তা এখনই নিশ্চিত করতে হবে।
গোলাম রহমান, মহাসচিব, সুগার রিফাইনারি অ্যাসোসিয়েশন।

বাংলাদেশে চিনির বাজার এখন মূলত পাঁচটি পরিশোধন কারখানার হাতে। ওই পাঁচ কারখানা হলো মেঘনা সুগার রিফাইনারি, সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রি, এস আলম রিফাইন্ড সুগার রিফাইনারি, আবদুল মোনেম সুগার রিফাইনারি ও দেশবন্ধু সুগার রিফাইনারি। এসব কারখানা অপরিশোধিত চিনি এনে পরিশোধনের মাধ্যমে বাজারজাত করে থাকে। এর বাইরে খাদ্যপণ্য প্রস্তুতকারক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিশোধিত চিনি এনে বাজারজাত করে। এর পরিমাণ অবশ্য মোট আমদানির ১০ শতাংশের কম।

চিনি পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন সুগার রিফাইনারি অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব গোলাম রহমান বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ভারত রপ্তানি বন্ধ করলে বিশ্ববাজারে চিনির দাম বাড়তে পারে। তাতে দেশে আমদানি ও সরবরাহ নিয়ে খুব সমস্যা হবে না। কারণ, অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করা যাবে। তবে এ জন্য চিনি আমদানির ঋণপত্র খুলতে যাতে কোনো সমস্যা না হয়, তা এখনই নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশ মূলত ব্রাজিল থেকেই অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে আসছে। করোনার আগের বছরগুলোয় মোট অপরিশোধিত চিনি আমদানির ৪–১৩ শতাংশ আনা হতো ভারত থেকে। এর বাইরে থাইল্যান্ড থেকেও মাঝেমধ্যে চিনি আমদানি করা হতো। তবে করোনার সময় বিশ্বব্যাপী জাহাজভাড়া বেড়ে গেলে ভারত থেকে আমদানি বাড়তে থাকে। কারণ, ভারত থেকে আমদানির ক্ষেত্রে পরিবহনভাড়া কম পড়ে। যেমন ২০২১–২২ অর্থবছরে অপরিশোধিত চিনির ৪৪ শতাংশ ভারত থেকে আমদানি হয়েছে। গত অর্থবছরও মোট আমদানির ৩৯ শতাংশ হয়েছে ভারত থেকে।

আমদানিকারকেরা জানান, ভারত থেকে পণ্য আমদানিতে খরচ কম পড়ে। আবার দ্রুততম সময়ে আমদানি করা যায়। ভারত রপ্তানি বন্ধ করার অর্থ হলো ব্রাজিল বা অন্য দেশ থেকে আমদানিতে পণ্য পরিবহনভাড়া বাবদ বাড়তি টাকা পরিশোধ করতে হবে। অর্থাৎ ভারতের রপ্তানি বন্ধের প্রভাব পড়বে পণ্য আমদানির খরচে।

গত বছরের জুলাই–আগস্ট থেকে দেশের বাজারে চিনি নিয়ে অস্থিরতা দেখা দেয়। কখনো গ্যাস–বিদ্যুৎ সমস্যায় উৎপাদন ব্যাহত হয়ে বাজার অস্থিতিশীল হয়েছে। আবার কখনো বিশ্ববাজারে দাম বাড়ায় ও দেশে ডলারের বিনিময়মূল্য বেড়ে যাওয়ায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। শুধু ডলারের বিনিময়মূল্য বাড়ায় এক বছরের ব্যবধানে চিনি আমদানিতে খরচ ২৭ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে আবার গত অর্থবছরে ঋণপত্র (এলসি) সংকটে চিনি আমদানি কমে যাওয়ায় সরবরাহেও সমস্যা দেখা দেয়। এভাবে এক সংকট কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আরেক সংকটের মুখে পড়তে হচ্ছে।

এদিকে দেশে চিনির দাম বাড়ায় ক্রেতাদের স্বস্তি নেই অনেক দিন ধরে। খুচরা বাজারে চিনির দাম শতক পেরিয়েছে অনেক আগেই। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, বাজারে এখন প্রতি কেজি খোলা ও প্যাকেটজাত চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৩০–১৩৫ টাকায়।

আবার চিনির দাম বাড়ায় চাহিদাও কমেছে। এতে ব্যবসায়ীরা আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন। যেমন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী গত অর্থবছরে ১৮ লাখ ৩৬ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে। পরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৬৬ হাজার টন। এর আগে ২০২১–২২ অর্থবছরে অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছিল ২৪ লাখ ২৪ হাজার টন।

দেশে উৎপাদিত চিনি দিয়ে চাহিদার ১ শতাংশও মেটানো যায় না। এ জন্য চিনি আমদানি করেই চাহিদা মেটাতে হয়। বিশ্ববাজারে কোনো রপ্তানিকারক দেশ চিনি রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করলে বা চিনির দাম বাড়লে তাতে দেশে উদ্বেগ দেখা দেবে, এটাই স্বাভাবিক।

চিনি নিয়ে এমন সংকটের সময় ভোক্তাদের কীভাবে স্বস্তি মিলতে পারে জানতে চাইলে একজন আমদানিকারক প্রথম আলোকে জানান, বিশ্ববাজারে যদি সামনে দাম বাড়ে, তাহলে দেশেও বাড়বে। তবে সরকার চাইলে শুল্ককর কমিয়ে স্বস্তি দিতে পারে। কারণ, এখন প্রতি কেজি চিনি আমদানিতে ৪০ টাকার বেশি শুল্ককর দিতে হচ্ছে।