অগ্রণীর 'আগ্রাসী ডিসেম্বর'

শুধু ডিসেম্বর মাসেই প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করেছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংক। এ জন্য ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকটি ছয়বার পরিচালনা পর্ষদের সভা করেছে। এর মধ্যে মাসের শেষ সপ্তাহেই করেছে তিনটি সভা, যাকে আগ্রাসী ডিসেম্বর হিসেবেই দেখছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা। এসব সভায় ব্যাংকটির বেশির ভাগ পর্ষদ সদস্য অংশ নেন। সব সভায় উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষকও।

শুধু ঋণ অনুমোদন নয়, ঋণ বিতরণেও ব্যাংকটি ২০১৮ সালে আগ্রাসী আচরণ করেছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে যে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর (এমওইউ) করেছিল অগ্রণী ব্যাংক, বেশি ঋণ বিতরণ করে তার সীমাও লঙ্ঘন করেছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তারাই বলছেন, নির্বাচনী মাসে এভাবে তড়িঘড়ি করে ঋণ অনুমোদন করায় সবার মধ্যেই নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এসব ঋণের যথাযথ ব্যবহার খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

তবে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল-ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ঋণ নবায়ন, পুনঃ তফসিল, অবলোপনসহ বিভিন্ন কারণে ডিসেম্বর মাসে পর্ষদের বেশি সভা হয়। একটি বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য প্রায় ৭০০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন পায়। এটা পরের মাসেও দেওয়া যেত। কিন্তু সুদসহ বিভিন্ন আয়ের কারণে ওই মাসে বেশি ঋণ অনুমোদর দেওয়া হয়, যাতে বছরের আর্থিক প্রতিবেদন ভালো হয়।

এমওইউর শর্ত লঙ্ঘনের কারণ প্রসঙ্গে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সরকারের বিভিন্ন অগ্রাধিকার প্রকল্পে ঋণ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিবছর নতুন করে অনেক সুদ যুক্ত হয়। এসব কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া শর্তও অতিক্রম করতে হয়েছে।

জানা যায়, ২০১৮ সালের ৩, ১০, ১৯, ২৩, ২৪ ও ২৬ ডিসেম্বর অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। এসব সভায় ১ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকার ফান্ডেড ও ৭২৩ কোটি টাকার নন-ফান্ডেড ঋণ অনুমোদন পায়। ফান্ডেড ঋণ হলো সরাসরি অর্থায়ন। আর নন-ফান্ডেড ঋণ হলো গ্যারান্টি, ঋণপত্রসহ বিভিন্ন সেবা, যাতে তাৎক্ষণিক অর্থসুবিধা দিতে হয় না, তবে একটা সময় পর এসব দায় ঋণে পরিণত হয়। বিশেষ করে রাষ্ট্র খাতের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি হয়ে পড়া বেশির ভাগ ঋণই প্রথম নন-ফান্ডেড ঋণ ছিল।

অগ্রণী ব্যাংক পর্ষদের ৩ ডিসেম্বরের সভায় ৮৮ কোটি টাকার ফান্ডেড ও ৫৩০ কোটি টাকার নন-ফান্ডেড ঋণ অনুমোদিত হয়। ১০ ডিসেম্বরের সভায় ৭ কোটি ও ১৯ ডিসেম্বর ১০১ কোটি টাকার ঋণ, ১৯ ডিসেম্বর ৩ কোটি টাকার নন-ফান্ডেড ঋণ, ২৩ ডিসেম্বর দেওয়া হয় ৮০৮ কোটি টাকার ফান্ডেড ও ১৮৬ কোটি টাকার নন-ফান্ডেড ঋণ। পরদিন আবারও সভা ডেকে ৬৪১ কোটি টাকার ফান্ডেড ও ৪ কোটি টাকার নন-ফান্ডেড ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়। আর ২৬ ডিসেম্বর অনুমোদন পায় ৩ কোটি টাকার ফান্ডেড ও ৫০ লাখ টাকার নন-ফান্ডেড ঋণ।

অগ্রণী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের তুলনায় সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ বেশি ঋণ বিতরণের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করেছিল ব্যাংকটি। তবে বছর শেষে ২৩ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম অগ্রণী ব্যাংকেরও পর্যবেক্ষক। গতকাল এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘ঠিক কারণ মনে নেই, কী কারণে ওই মাসে এত সভা হয়েছিল। আমি সব সভাতেই ছিলাম। তবে ঋণ যা গেছে, সব নথিপত্র যাচাই করা হয়েছে। সাধারণত বছরের শেষ মাসে ব্যাংকগুলো পুনঃ তফসিল, অবলোপন, নবায়নসহ বিভিন্ন কারণে বেশি পর্ষদ সভা ডাকে।’ আর সীমা লঙ্ঘন করে বেশি ঋণ দেওয়ার বিষয়টি তিনি জানেন না বলে জানান।

জানা গেছে, ২০১৮ সালে ব্যাংকটি ঋণ বিতরণে আগ্রাসী হলেও খেলাপি ঋণ আদায় কমেছে। ২০১৭ সালে ব্যাংকটি খেলাপি ঋণ থেকে ৬৬৮ কোটি টাকা নগদ আদায় করলেও ২০১৮ সালে তা কমে হয় ৩৯৮ কোটি টাকা। ২০১৭ সালে ব্যাংকটি সব মিলিয়ে ২ হাজার ৯৫ কোটি টাকা আদায় দেখিয়েছিল। গত বছর তা কমে হয়েছে ১ হাজার ১০৫ কোটি টাকা। ফলে গত ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৫ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।

২০১৮ সাল শেষে অগ্রণী ব্যাংকের আমানত দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। এ সময় ঋণ ও অগ্রিমের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৯ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে ব্যাংকটি ৯৫৭ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফা দেখিয়েছে। তবে প্রকৃত মুনাফা কত হবে, সে হিসাব এখনো চূড়ান্ত হয়নি।

২০১৮ সাল শেষে যে ১৫টি ব্যাংক সঞ্চিতি সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে, তার মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকও আছে। মুন গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে কয়েক বছর আগে আলোচনায় আসে ব্যাংকটি। ওই সময়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আবদুল হামিদকে চাকরিও হারাতে হয়। চট্টগ্রামে বড় অঙ্কের ঋণ দিয়ে আটকা পড়েছে অগ্রণী ব্যাংক, যা আদায় করতে না পেরে অবলোপন করে ফেলেছে তারা।