অনুমোদন ছাড়া ব্যাংকের পর্ষদ সভায় উপস্থিতি

বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই পরিচালক হিসেবে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার এন্ড কমার্স (এসবিএসি) ব্যাংক লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদের সভায় নিয়মিতভাবে অংশ নিচ্ছেন বিতর্কিত মুন গ্রুপের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ (২০১৩ পর্যন্ত সংশোধিত)-এর বিধান অনুযায়ী, পরিচালক পদে নিয়োগ পেতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন লাগবে। এরপরই পরিচালক হিসেবে গণ্য হবেন এবং পর্ষদ সভায় অংশ নিতে পারবেন।

মিজানুর রহমান নতুন প্রজন্মের ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্যোক্তা পরিচালকদের একজন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তার ও কারাভোগ এবং কারামুক্তির পর দীর্ঘদিন বিদেশে অবস্থানের কারণে পরিচালক পদ হারান মিজান। দেশে ফিরে আবার তিনি ব্যাংকের পরিচালক পদ ফিরে পেতে তোড়জোড় শুরু করেন। একপর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রয়োজনীয় অনুমোদন ছাড়াই মিজানকে পরিচালক পদ ফিরিয়ে দেয় এসবিএসি কর্তৃপক্ষ। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাঁকে পর্ষদ সভায় অংশ নিতে অবৈধভাবে নিয়মিত আমন্ত্রণ জানিয়ে যাচ্ছে।

এসবিএসি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় রাজধানীর দিলকুশায় অবস্থিত মিজানের মালিকানাধীন সানমুন স্টার টাওয়ারে। বেআইনিভাবে পর্ষদ সভায় অংশ নিয়েই তাই বাড়িওয়ালা হিসেবে ব্যাংকের কাছ থেকে নিজের ভবনের ভাড়া বাড়িয়ে নিয়েছেন মিজান।

জানতে চাইলে এসবিএসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান এস এম আমজাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমনিতেই বিপদে আছি। তাঁর (মিজানুর রহমান) বিষয়ে কথা বললে বিপদ বড় হতে পারে। বেকায়দায় পড়েছি। যত দ্রুত সম্ভব, অন্য কোথাও জায়গা পেলে এ ভবন থেকে ব্যাংককে সরিয়ে নেব।’

আর বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া মিজানকে পর্ষদ সভায় অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়ে ব্যাংকের চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন বলেন, ‘তিনি ঋণখেলাপি না—এ মর্মে আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে এসেছেন। এ কারণে তাঁকে পরিচালক করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নেওয়া হয়নি।’

পর্ষদ সভায় বেআইনিভাবে অংশগ্রহণের বিষয়ে মিজানুর রহমানের বক্তব্য হলো, তিনি এ ব্যাংকের মালিকদের একজন। ব্যাংকের আমন্ত্রণেই পর্ষদ সভায় অংশ নিচ্ছেন।

এদিকে মুন গ্রুপের ৪০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়মিত (পুনঃ তফসিল) করে দিয়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকও তাতে অনাপত্তি দিয়েছে। ফলে আগামী তিন বছর মুন গ্রুপকে কোনো ঋণ শোধ করতে হবে না, করতে হবে পরের ৯ বছরে। নতুন করে ব্যাংক থেকে টাকাও নিতে পারবে এ গ্রুপ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ গত ৮ জুন এক চিঠিতে মুন গ্রুপের ঋণ পুনঃ তফসিল বিষয়ে অনুমতি দেয়। এরপরই ঋণ নিয়মিতকরণ কার্যকর হয়েছে। অথচ মুন গ্রুপের অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনায় গত বছরের ৩০ জুন অপসারিত হয় ব্যাংকটির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ আবদুল হামিদ। এ ঘটনায় ওই দিনই দুর্নীতি দমন দমন কমিশন আটক করে ডিএমডি মিজানুর রহমান খানকে।

মুন গ্রুপের ঋণ নিয়মিত করার বিষয়ে জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের বর্তমান এমডি মোহাম্মদ শামস-উল-ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালত থেকে মুন গ্রুপের ঋণ নিয়মিত করার নির্দেশনা এসেছে। এ ছাড়া গ্রুপটিকে আর কী কী সুবিধা দিতে হবে, তারও নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত। আদালতের নির্দেশনা মেনেই গ্রুপটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে।’

অগ্রণী ব্যাংকের ঋণের বিষয়ে মিজানুর রহমান বলেন, ‘ষড়যন্ত্র করে আমাকে জেলে পাঠিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। এখন আদালতের নির্দেশ এসেছে, ঋণ নিয়মিত করে দিয়েছে ব্যাংক। আমিও টাকা শোধ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। আমার যে পরিমাণ সম্পদ আছে, তার কিছু অংশ বিক্রি করলেই সব ঋণ শোধ হয়ে যাবে।’

এসবিএসির পর্ষদে মিজানের ফেরা

গত ১০ মে এসবিএসি ব্যাংকের বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) মুন গ্রুপের কর্ণধার মিজানুর রহমানকে পরিচালক হিসেবে নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক সেটি অনুমোদন করেনি। তা সত্ত্বেও গত ৭ জুন, ২১ জুন ও ১৩ জুলাই ব্যাংকটির ৬৩, ৬৪ ও ৬৫তম সভায় অংশ নেন মিজানুর রহমান। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বলেন, ‘ব্যাংকে কেউ নতুন করে পরিচালক হতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিতে হবে। সে পুরোনো পরিচালক হোক আর নতুন হোক। যদি কেউ বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়াই পর্ষদ সভায় অংশগ্রহণ করে, তবে তা নিয়মের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।’

এ বিষয়ে মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমি ব্যাংকের মালিক। পরিচালক হতে আমার অনুমোদন লাগবে না। দীর্ঘদিন জেলে ছিলাম, এ কারণে বাদ পড়েছিলাম। এখন আবার যাওয়া শুরু করেছি। ব্যাংক নিজেই আমাকে সভায় অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।’

এর আগে ২০১৩ থেকে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মিজানুর রহমান এসবিএসির পরিচালক ছিলেন। তবে ২২ মাস জেলে ও বিদেশে অবস্থানের কারণে পর্ষদ সভায় অংশ নিতে না পারায় ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁর পরিচালক পদ শূন্য হয়ে যায়।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া পরিচালক হিসেবে ৬৪তম সভায় অংশ নিয়ে সানমুন স্টার টাওয়ারের ভাড়া বাড়াতে ব্যাংকের ওপর চাপ তৈরি করেন মিজান। ওই সভায় ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে প্রতি বর্গফুটের ভাড়া ১১৫ থেকে বাড়িয়ে ১২৫ টাকা করার সিদ্ধান্ত হয়। গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত নতুন এ ভাড়া কার্যকরের সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া গত ১ মে থেকে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতি বর্গফুট ভাড়া ১৬০ টাকা করার সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকও তাতে অনুমোদন দিয়েছে। যদিও ওই ভবনে মার্কেন্টাইল ব্যাংক প্রতি বর্গফুট ভাড়া দিচ্ছে ৮৫ টাকা, সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংক দিচ্ছে ১১০ টাকা। সানমুন স্টার টাওয়ারের ৩৩ হাজার বর্গফুট জায়গা প্রধান কার্যালয় হিসেবে ভাড়ায় ব্যবহার করছে এসবিএসি।

মিজানুর রহমান বলেন, ‘জেলে থাকার কারণে দীর্ঘদিন ভাড়া বাড়ানো হয়নি। আমার অনুপস্থিতিতে এত দিন সবাই নিজের মতো করে চলেছে। নিজেদের মতো করে ভাড়া দিয়েছে। আমি ফিরে এসে কয়েক বছর পর ভাড়া বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি। কেউ না থাকতে চাইলে চলে যাবে, আপত্তি নেই।’

ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল ইসলাম গত শনিবার বলেন, ‘আমরা তাঁর বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নেব। ভুল হলে ক্ষমা চেয়ে নেব।’