২০২০ এর শিক্ষা, ২০২১ এর প্রত্যাশা
অভিশপ্ত বছর পার করলাম
সারা বিশ্বই ২০২০ সালকে বিদায় দেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। জীবন ও জীবিকার ওপর আঘাতের যে চিত্র বছরজুড়ে মানুষ দেখেছে, গত ১০০ বছরেও তা দেখা যায়নি। অর্থনৈতিক মন্দার আভাস ছিল ঠিকই, কিন্তু বিশ্বব্যাপী ছোট-বড় সব অর্থনীতি একসঙ্গে এভাবে বিপর্যয়ে পড়বে, কেই-বা ভাবতে পেরেছিল। ২০২০ সাল যেমন বিপর্যয়ের বছর, তেমনি অনেক কিছু শিক্ষা নেওয়ারও বছর। কোভিড-১৯-এর আগের বিশ্ব আর পরের বিশ্বের মিল কোনো দিনই হবে না। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যাঁরা সরাসরি জড়িত, যাঁরা কাছ থেকে দেখছেন অর্থনীতিকে, তাঁদের কাছে প্রশ্ন ছিল তিনটি।
১. কেমন গেল ২০২০
২. কী শিক্ষা হলো ২০২০-এ, এবং
৩. ২০২১-এ কী করবেন, কী হবে কৌশল।
২০২০ সালটা অর্থনৈতিক ও সামাজিক—দুই ক্ষেত্রেই একটি অভিশপ্ত বছর পার করলাম। কোভিড আসার আগেই অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক দুর্বল অবস্থায় ছিল। যেমন রপ্তানি নেতিবাচক ছিল। কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় হয়নি। এর মানে, ভোক্তা ব্যয় দুর্বল ছিল। আর আমদানি বিশেষ করে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি আগের চেয়ে কমে যাচ্ছিল। এটি বিনিয়োগ দুর্বলতা প্রকাশ করে। এমন অবস্থায় কোভিড সব তছনছ করে দেয়। অন্য সময় অর্থনীতিতে যত আঘাতই আসে না কেন, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে খুব বেশি প্রভাব পড়ে না। পড়লেও তা সাময়িক। কিন্তু কোভিড এই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে।
কৃষি খাতের পরে এই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতেই সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান হয়। কিন্তু কোভিডের কারণে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নামে। তাঁরা কোনোভাবে পণ্য বাজারজাত করতে পারেনি। চাহিদাও কম ছিল। ফলে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। বেকার হয়ে পড়ে লাখ লাখ শ্রমিক। আবার সরকারি বিভিন্ন সহায়তার ফলে কৃষি খাতের শঙ্কা কাটিয়ে ফসল ঘরে তুলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেছে। কিন্তু কৃষি খাতের অন্য উপশাখা যেমন মৎস্য, পোলট্রির মতো ব্যবসা-বাণিজ্যে বিপর্যয় নামে।
গত এক শ বছরে বিশ্ব অর্থনীতি এমন মন্দায় পড়েনি। বাংলাদেশেও ভালোভাবেই এর আঁচড় লেগেছে। বেকারত্ব ২৪ শতাংশে উন্নীত হয়। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশ নেতিবাচক হয়ে যায়। শহরে কাজের সুযোগ কমে যায়। বেকার হয়ে যাওয়ায় মানুষ গ্রামে ফিরে যেতে শুরু করেন। গ্রামে ফেরার বাংলাদেশে এমন বিপরীতমুখী প্রবণতা আর কখনো দেখা যায়নি। যেমন গৃহকর্মীরা বাসাবাড়িতে কাজ হারিয়েছেন। ঘরভাড়া, খাবার—এসব খরচ মেটাতে না পেরে তাঁরা গ্রামে ফিরে গেছেন। অনেক নিম্নমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্তরা যে গ্রামে ফিরে গেছেন, তা বোঝা যায় ঢাকা শহরে বহু বাড়িতে এখন টু-লেট ঝুলছে।
করোনার কারণে ২০২০ সালে আমরা কয়েকটি শিক্ষা নিলাম। প্রথমত, ধারণা ছিল ঘূর্ণিঝড়, বন্যার মতো দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ বেশ ভালো। কিন্তু স্বাস্থ্যঝুঁকির মতো দুর্যোগ মোকাবিলা করার মতো দক্ষতা অর্জন করতে পারিনি। বছরের পর বছর স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগে যে অবহেলা দেখানো হয়েছে, তা এবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
দুর্নীতি তার নিজস্ব গতিতেই চলে। মানবতার সংকটকালেও অনেকেই লোভ সামলাতে পারেনি। ঘটেছে রিজেন্ট ও শাহেদ কেলেঙ্কারি; অতি উচ্চমূল্যে সুরক্ষাসামগ্রী কেনার মতো ঘটনা।
দ্বিতীয়ত, দুর্নীতি তার নিজস্ব গতিতেই চলে। মানবতার সংকটকালেও অনেকেই লোভ সামলাতে পারেনি। ঘটেছে রিজেন্ট ও শাহেদ কেলেঙ্কারি; অতি উচ্চমূল্যে সুরক্ষাসামগ্রী কেনার মতো ঘটনা। তৃতীয়ত, করোনার কারণে গরিব মানুষের সংখ্যা আরও বেড়েছে। গরিবেরা আরও গরিব হয়েছে। তাদের জন্য সরকার বেশ কিছু সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি নিলেও দুর্নীতির কারণে তাদের সবার কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। চতুর্থত, বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য-উপাত্তনির্ভর নীতি গ্রহণে ব্যর্থতা। যেমন নগদ সহায়তার অর্থ প্রকৃত সুবিধাভোগীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়নি। পঞ্চমত, ডিজিটাল বৈষম্যের চিত্র ফুটে উঠেছে।
মোটা দাগে আগামী বছর কয়েক ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন, টিকা ছাড়া অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। মানবসম্পদ তৈরির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর খোলার কৌশল ঠিক করতে হবে। অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প কারখানার জন্য যে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছিল, তা মাঝারি শিল্প মালিকেরা নিয়ে গেছেন। কারণ, ছোটরা ব্যাংকিং ব্যবস্থায় নেই। কোভিডের আগেই আর্থিক খাত সংকটে ছিল। করোনার কারণে ঋণখেলাপি ঘোষণায় শর্ত শিথিল করা হয়। ফলে এখন ব্যাংক খাতের সার্বিক স্বাস্থ্য কেমন, তা বোঝা যাচ্ছে না। এই খাতে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন।
এ ছাড়া ২০২১ সালের দ্বিতীয়ার্ধে বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করবে বলে আশা করা হচ্ছে। করোনার ঝুঁকি শেষ হলে উন্নত দেশে কেনাকাটা, ভ্রমণ, ভোগব্যয় বাড়তে পারে। ওই সব অর্থনীতিতে বড় উল্লম্ফন শুরু হবে। রপ্তানি ও শ্রমশক্তিতে বাংলাদেশ এ সুযোগ নিতে পারে। কিন্তু তখন চাহিদা যত বাড়বে সেই সক্ষমতা আছে কি না, তা দেখতে হবে। যেমন তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ যদি হঠাৎ করে ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়, তাহলে সেই পোশাক তৈরি, বন্দর ও পরিবহন সুবিধা কতটা আছে, তা দেখতে হবে। এ ছাড়া রপ্তানি আদেশ বাড়লে আমদানিও বাড়বে। সার্বিকভাবে বন্দরের সক্ষমতার কথাও বিবেচনায় রাখতে হবে।