অর্থনীতির সাত বিস্ময়
মানুষের সংকটকে পুঁজি করে দুর্নীতির চেষ্টা যেমন ছিল, তেমনি ছিল ব্যাংক এমডিকে গুলি করার মতো বিস্ময়কর ঘটনা।
করোনায় বিপর্যস্ত অর্থনীতিতে দারিদ্র্য বেড়েছে, মানুষ কাজ হারিয়ে গ্রামে ফিরে গেছে, বৃদ্ধি পেয়েছে বৈষম্য।
কোভিড-১৯-এর সময়ে দুর্নীতির ক্ষেত্রে অভিনবত্বের পরিচয় দেয় বাংলাদেশ। সুরক্ষা পণ্য কেনাকাটা, কাজ দেওয়ায় অনিয়ম, অসহায় ও দুস্থদের ত্রাণ
অর্থনীতি চাপে ছিল করোনাভাইরাস হানা দেওয়ার আগেই। গত এক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো রপ্তানি আয়ে ছিল ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি, আমদানিও ঋণাত্মক। রাজস্ব আয়ে ছিল বড় ঘাটতি, রাজস্ব আয় কম থাকায় বাড়ছিল সরকারের ঋণ করার প্রবণতা। বেসরকারি বিনিয়োগ বহু বছর ধরেই স্থবির। মূলত একটি ছাড়া অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই ছিল নিম্নমুখী।
এর মধ্যেই বাংলাদেশে প্রথম কোভিড-১৯ শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। মার্চের শেষে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলে অর্থনীতি কার্যত অচল হয়ে পড়ে। জুলাই থেকে নতুন অর্থবছর শুরু হলে অর্থনীতিও ধীরে ধীরে উত্তরণের পথে যেতে শুরু করে। ঝুঁকি নিয়ে সরকারের অর্থনীতি সচল করার সাহসী সিদ্ধান্ত, ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিল এবং মানুষের টিকে থাকার চেষ্টায় অর্থনীতি অনেক দেশের তুলনায় এখনো ভালো অবস্থায়।
করোনায় বিপর্যস্ত অর্থনীতিতে অনেক মানুষের বিপর্যয় দেখা গেছে বছরজুড়ে। এ সময়ে দারিদ্র্য বেড়েছে, মানুষ কাজ হারিয়ে গ্রামে ফিরে গেছে, বৃদ্ধি পেয়েছে বৈষম্য। এ রকম একসময়ে অর্থনীতির অঘটনও কম ছিল না। এমন সব কাণ্ড ঘটেছে, তা ছিল বিস্ময়কর।
১. সিকদারপুত্রদের গুলি
ঘটনাটি ৭ মের। সীমিত আকারে ব্যাংকের সেবা ছাড়া সবকিছুই তখন বন্ধ। এ রকম এক দমবন্ধ পরিবেশের মধ্যেই এক্সিম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়া ও অতিরিক্ত এমডি মোহাম্মদ ফিরোজ হোসেনকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করেন সিকদার গ্রুপের দুই পরিচালক। এ নিয়ে সিকদার গ্রুপের মালিক জয়নুল হক সিকদারের ছেলে এবং গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রন হক সিকদার ও তাঁর ভাই দিপু হক সিকদারের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলা করে এক্সিম ব্যাংক।
বিস্ময় এখানেই শেষ নয়। এরপর দুই ভাই রোগী সেজে দেশ ত্যাগ করেন। আর এই ঘটনার তৃতীয় বিস্ময় হচ্ছে, দুই ভাই পলাতক থাকা অবস্থায় জামিনের আবেদনও করেন। এ জন্য অবশ্য তাঁদের জরিমানা দিতে হয়েছে।
২. দুর্নীতির অভিনবত্ব
কোভিড-১৯-এর সময়ে দুর্নীতির ক্ষেত্রে অভিনবত্বের পরিচয় দেয় বাংলাদেশ। সুরক্ষা পণ্য কেনাকাটা, কাজ দেওয়ায় অনিয়ম, অসহায় ও দুস্থদের ত্রাণ বিতরণে দুর্নীতি—এসব তো ছিলই; তবে সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে ভুয়া পরীক্ষার কেলেঙ্কারি। সাহেদ বা জিকেজি কেলেঙ্কারি ছিল অন্যতম আলোচিত ঘটনা। দেশ ও মানুষের চরম সংকটের সময়েও থেমে থাকেনি দুর্নীতি। বরং জীবন ও জীবিকার সংকটকে অনেকেই বেছে নিয়েছিলেন অবৈধ আয়ের সুযোগ হিসেবে।
৩. পি কে হালদারের আবদার
প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার দেশ থেকে পালিয়ে যান ২০২০ সালের শুরুতেই। বছরের পর বছর ধরে প্রভাবশালীদের সহায়তায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করে অর্থ আত্মসাৎ করছিলেন। ২০১৯ সালে পিপলস লিজিং দেউলিয়ার পর্যায়ে গেলে পি কে হালদারের সাম্রাজ্যে ধস নামা শুরু হয়। তবে আরও বিস্ময়কর কাণ্ড ঘটান তিনি চলতি বছরেই। সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ আত্মসাৎকারী পি কে হালদার গত সেপ্টেম্বরে দেশে ফিরবেন বলে আদালতে জানান।
এ জন্য তিনি হয়রানি না করার শর্ত দেন। একজন পলাতক আসামির এ ধরনের আবদার ইতিহাসে নজিরবিহীন। তবে দেশে ফিরলেও জেলে থাকতে হবে আদালতের এই আদেশে শেষ পর্যন্ত তিনি অন্য দেশে বসে কলকাঠি নাড়ানোকেই শ্রেয় মনে করেছেন।
৪. পুরোনো চেহারায় পোশাক খাত
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৬ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক থেকে। দেশের মধ্যে কর্মসংস্থানের বড় উৎস এই খাত। সরকারের নীতি, আর্থিক সহায়তা ও প্রশ্রয়ে এখন দেশের সবচেয়ে বড় খাত এটি। অথচ এখনো নিজের পায়ে তারা দাঁড়াতে শেখেনি বা দাঁড়াতে চায়নি।
করোনার সময়ও বাড়তি সুবিধা নিয়েছে তৈরি পোশাক খাত। শ্রমিকদের বেতন–ভাতা দিতে অর্থ নিয়েছে, এখন আবার মালিকদের একটি পক্ষ বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট দিতেও নারাজ। তবে বড় বিস্ময় ছিল করোনার তীব্র সংক্রমণের সময়ে শ্রমিকদের ঢাকাসহ কর্মস্থলে আনা-নেওয়ার অমানবিক কাণ্ড।
৫. ব্যাংক চেয়ারম্যান-কাণ্ড
শুরু জনতা ব্যাংক থেকে। গত জুলাইয়ের শেষ জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ থেকে জামালউদ্দিন আহমেদকে সরিয়ে দেয় সরকার। সরিয়ে দেওয়ার কারণ হিসেবে কোনো কিছু পর্দার পেছনের খবর অজানা ছিল না। নির্দিষ্ট কিছু গ্রাহকের সঙ্গে বিশেষ সখ্যর কারণেই তাঁকে সরে যেতে হয়।
তবে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের কাণ্ড একটু অন্য রকম। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়োগ দেওয়া অগ্রণী ব্যাংকের পর্যবেক্ষক, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক লীলা রশিদ অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখতের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। তাঁর অভিযোগ ছিল, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় তাঁকে ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হয় না, কথা বলার সময় তাঁকে আটকে দেওয়া হয় এবং আক্রমণাত্মক আচরণও করা হয়।
এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত চালায় এবং অভিযোগের সত্যতা পেলেও তৃতীয়বারের মতো জায়েদ বখতের নিয়োগ পেতে অবশ্য কোনো সমস্যা হয়নি। বরং নিজে থেকেই সরে গেছেন লীলা রশিদ।
৬. জিডিপির নেশা
করোনার সময়ে সারা বিশ্ব যখন অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে, ঠিক তখনই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএস জানিয়ে দেয়, বাংলাদেশ মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ।
অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসের প্রবণতা ধরে সাধারণ জিডিপি প্রবৃদ্ধির একটি প্রাথমিক হিসাব দেওয়া হয়। অর্থবছর শেষ হলে সেই হিসাব
চূড়ান্ত করতে দুই থেকে তিন মাস লেগে যায়। কিন্তু প্রায় ৬ মাস শেষ হতে চলল, এখন পর্যন্ত গত অর্থবছরের জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব জানা গেল না। এ আরেক বিস্ময়।
৭. সত্যিকারের বিস্ময়
বিশ্বব্যাপী প্রাক্কলন ছিল করোনায় বিশ্বব্যাপী প্রবাসী আয় কমবে। অথচ এখন পর্যন্ত প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি ৪১ শতাংশের বেশি। ২০১৯ সালে প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে ২ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
করোনার সময় প্রবাসীরা বাড়তি আয় পাঠাচ্ছেন, নাকি শেষ সম্বল পাঠিয়ে দিচ্ছেন—এ প্রশ্ন অনেকেরই। তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনাই কি মূল কারণ? আর সেটি হলে মানতেই হবে, এত দিন ভিন্ন বা অবৈধ পথেই প্রবাসী আয়ের লেনদেন ছিল অনেক বেশি। সব মিলিয়ে চরম বিপদের সময় রেকর্ড পরিমাণ প্রবাসী আয় ছিল সত্যিকারের কাঙ্ক্ষিত বিস্ময়।