বেসরকারি খাত ছাড়া বিমায় ভালো কিছু সম্ভব নয়

এম মোশাররফ হোসেন

বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) চেয়ারম্যান এম মোশাররফ হোসেন গত রোববার প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিমা খাতের নানা দিক তুলে ধরেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফখরুল ইসলাম

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: তৃতীয় জাতীয় বিমা দিবসকে সামনে রেখে বিমা খাতকে কোথায় দেখতে পাচ্ছেন? বাংলাদেশ কি কোনো সুখকর জায়গায় আছে?

এম মোশাররফ হোসেন: দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় বিমা খাতের প্রিমিয়াম আয় এখনো ১ শতাংশের কম। তবে এটা সত্য যে জিডিপির আকার যেভাবে বাড়ছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না বিমা খাত। জীবনবিমার প্রিমিয়াম আয় সাড়ে নয় হাজার এবং সাধারণ বিমার প্রিমিয়াম আয় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। আমরা বিমার আওতা বৃদ্ধির দিকে নজর দিচ্ছি। কত বেশি মানুষকে বিমার গ্রাহক করা যায়, সেটাই আমাদের এখন অন্যতম কাজ।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: অন্যতম কাজ করার জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে?

মোশাররফ হোসেন: প্রথমেই আমরা ব্যাংকান্স্যুরেন্স বাস্তবায়নে নজর দিচ্ছি। এটা হয়ে গেলে আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে সমাজের বড় একটা অংশ বিমার আওতায় চলে আসবে। বর্তমানে জীবনবিমায় প্রায় ২ কোটি ও সাধারণ বিমায় ৩০ লাখ গ্রাহক আছেন। আর ব্যাংকে রয়েছেন প্রায় ১০ কোটি হিসাবধারী। তাদের অর্ধেককেও যদি বিমার আওতায় আনা যায়, তাহলে প্রিমিয়াম আয় কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। ব্যাংকান্স্যুরেন্স হলে পলিসি বাতিল হওয়ার আশঙ্কাও কমবে। আর অনলাইনের মাধ্যমে বিমা পণ্য বিক্রির আয়োজন করা আমাদের দ্বিতীয় প্রধান কাজ। ঘরে বসে তখন প্রিমিয়ামের টাকা দেওয়া যাবে, সব হিসাবও দেখা যাবে। তৃতীয়ত করপোরেট এজেন্ট এবং চতুর্থত ব্রোকার পদ্ধতি চালু করার উদ্যোগ নিয়েছি। এ কয়েকটি কাজ হয়ে গেলেই বিমা খাতের উল্লেখযোগ্য অবদান দৃশ্যমান হবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বেসরকারিসহ পুরো বিমা খাতকে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার আওতায় আনার আগে কাজগুলো কীভাবে সম্ভব? বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এ ব্যাপারে একটা প্রকল্প চললেও কাজ চলছে শুধু চারটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে।

মোশাররফ হোসেন: ঠিকই বলেছেন। বেসরকারি খাত ছাড়া ভালো কিছু সম্ভব নয়। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে আইডিআরএ, বিমা একাডেমি, সাধারণ বীমা করপোরেশন ও জীবনবীমা করপোরেশনকে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় আনার কাজ চলছে। বেসরকারি খাতকে কীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, সেই চেষ্টা করছি। অন্তত প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজটা করতেই হবে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে হবে কি না, নিশ্চিত নই। তবে হবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: একদিকে বিমার আওতা বৃদ্ধির কথা বলছেন, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠিত পণ্য তৃতীয় পক্ষের বিমা (থার্ড পার্টি ইনস্যুরেন্স) বাতিল করে দিয়েছেন। এখন তো পলিসি ছাড়াই গাড়ি চলে রাস্তায়।

মোশাররফ হোসেন: তৃতীয় পক্ষের বিমা ছিল নামকাওয়াস্তে। কেউ বিমা দাবি পেতেন না। পেলেও পেতেন ২০ হাজার টাকা। প্রিমিয়ামও ছিল কম, ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ধরলে ‘বিমা করা আছে’ বলে যাতে পার পাওয়া যায়, সেটাই ছিল এ বিমার উদ্দেশ্য। ২০১৮ সালে সড়ক পরিবহন আইনে বিমা করার কথা বলা আছে। কিন্তু কেউ করছেন না। বিমা দাবি যাতে পাঁচ লাখ টাকা হয়, সে জন্য আমরা একবার সব পক্ষকে নিয়ে বসেছিলাম। কাজ বেশি দূর এগোয়নি। গাড়ির বিমা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত বলে আমিও মনে করি।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: জীবনবিমা পলিসি এত বাতিল হয়ে যায় কেন?

মোশাররফ হোসেন: আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রথম বছরের ব্যবসা থেকে ১৫ শতাংশ বাদ হয়, ৮৫ শতাংশ টিকে থাকে। এ ছাড়া দ্বিতীয় বছরে ৫ থেকে ১০ এবং তৃতীয় বছরে ৫ শতাংশ বাতিল হয়। কিন্তু আমাদের দেশে প্রথম বছরেই ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ বাতিল হয়ে যায়, পলিসির বিপরীতে জমা হওয়া টাকাও কেউ ফেরত পায় না। এ সমস্যা দূর করতে একটা উপায় বের করেছি। প্রথম বছরে এজেন্টরা যে কমিশন পাবেন, তার ১০ শতাংশ কেটে রাখা হবে। এই ১০ শতাংশ পাবেন তারা দ্বিতীয় বছরের ১০ শতাংশ কমিশনের সঙ্গে একবারে ২০ শতাংশ। এটা করার ফলে দ্বিতীয় বছরে গ্রাহকদের ধরে রাখার ব্যাপারে এজেন্টদের মনোযোগ বেড়েছে। আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে পদক্ষেপটির একটি ভালো ফল পাওয়া যাবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের শিক্ষক সৈয়দ আবদুল হামিদের একটি প্রস্তাব রয়েছে, মুঠোফোনে মাসে ১০ টাকা কেটে সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিমা চালুর। এ ধরনের সর্বজনীন বিমা করা যায় কি?

মোশাররফ হোসেন: রেলের যাত্রীদের টিকিটের সঙ্গে এক টাকা করে বাড়তি নিয়ে একটা বিমা পণ্য চালু করা হয়েছিল। সৈয়দ আবদুল হামিদের প্রস্তাবটিও বেশ ভালো। অর্থ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এমনকি মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বসে এটা নিয়ে চিন্তা করা যাবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: কীভাবে চিন্তা করবেন? নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে আইডিআরএ তো বেশ দুর্বল। নিয়ন্ত্রক সংস্থার বড় একটি অংশ চাকরি নিয়ে একধরনের অনিশ্চয়তায় রয়েছেন।

মোশাররফ হোসেন: শুধু দুর্বল নয়, দুর্বলতম। তবে আইডিআরএর ৫০ জন কর্মীর চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তার বিষয়টির একটি সমাধান হবে। তাঁরা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, আইডিআরএ তা কাজে লাগাবে। আবার মানবিক একটি দিকও আছে। তাই এসব কর্মী নিষ্ঠুরতার শিকার হবেন না বলেই আমি বিশ্বাস করি।