আইন না মেনেই ভবন নির্মাণ

রাজউকের প্রধান কার্যালয় থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটারের মধ্যে অনুমোদন ছাড়া দীর্ঘদিন নির্মাণকাজ চলেছে

পুরান ঢাকার হাটখোলায় এফবিসিসিআই ভবন
ছবি: হাসান রাজা

জমি সরকারি টাকায় কেনা। ভবন নির্মাণের খরচের বড় অংশও দিয়েছে সরকার। এরপরও আইনকানুনের তোয়াক্কা না করেই বহুতল ভবন নির্মাণ করে ফেলেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)। রাজধানীর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান কার্যালয় থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটারের মধ্যে অনুমোদন ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে ভবনটির নির্মাণকাজ চললেও কোনো প্রকার প্রশ্ন তোলেননি নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির কর্তাব্যক্তিরা।

এভাবেই আইনকে পাশ কাটিয়ে রাজধানীর পুরান ঢাকার হাটখোলা সড়কে অভিসার সিনেমা হলের উল্টো পাশে কাচঘেরা সুরম্য ‘এফবিসিসিআই ভবন’ গড়ে উঠেছে। ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার প্রায় তিন বছর পর রাজধানীর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কাছ থেকে নকশার অনুমোদন নিয়েছে সংগঠনটি। গত বুধবার অনলাইনে এক অনুষ্ঠানে হঠাৎ করেই সংগঠনটির সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম নকশা অনুমোদন ছাড়া ভবন নির্মাণ ও সম্প্রতি সেটি অনুমোদনের বিষয়টি জানান। এরপর এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনার তৈরি হয়।

ভবনটির নির্মাণকাজ যখন শুরু হয়, তখন এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি ছিলেন হেলাল উদ্দিন। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভবনের জায়গাটি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার (কি পয়েন্ট ইনস্টলেশন বা কেপিআই) কাছাকাছি হওয়ায় বহুতল ভবন নির্মাণের অনাপত্তি পেতে দেরি হচ্ছিল। সময়মতো কাজ না করলে সরকারি টাকা ফেরত চলে যেত। তাই রাজউক থেকে প্রাথমিক অনুমোদন নিয়ে আমরা ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করি।’

তবে স্থপতি ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ অনুযায়ী রাজউক থেকে প্রাথমিক বা মধ্যবর্তী অনুমোদন নিয়ে ভবন নির্মাণের কোনো সুযোগ নেই। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই–বাছাই করে নকশার অনুমোদন দেন রাজউকের সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের অথরাইজড অফিসার। এই কাজ রাজউকের চেয়ারম্যানও করতে পারেন না।

২০১২ সালের ৭ মে হাটখোলার ১৪ দশমিক ৪৩ কাঠা জমির ওপর ১৩ তলা এফবিসিসিআই ভবন নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। তিনতলার বেসমেন্টসহ ১৬ তলা ভবনটির নির্মাণ ব্যয় ছিল ৩৬ কোটির বেশি।

এফবিসিসিআই কেন হাটখোলায়

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রয়াত আনিসুল হক ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত এফবিসিসিআইয়ের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। তিনি প্রতিটি জেলা চেম্বারের জন্য নিজস্ব ভবন নির্মাণ করার জন্য সরকারের কাছ থেকে অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা করেন। পরবর্তী সময়ে পণ্যভিত্তিক ব্যবসায়ী সংগঠনের জন্যও ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ পান। সেখান থেকে ৫ কোটি দিয়ে বেশ কিছু সংগঠনকে কম্পিউটার ও প্রিন্টার কিনে দেওয়া হয়। বাকি ১৫ কোটি টাকা দিয়ে প্রথম ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হলের জায়গা কেনার প্রাথমিক চিন্তাভাবনা করা হলেও পরে আইনি জটিলতায় তা বাতিল হয়ে যায়।

ওই সময় এফবিসিসিআইয়ের সদস্য পুরান ঢাকার এক ব্যবসায়ী আনিসুল হককে জানান, হাটখোলায় একটি জায়গা বিক্রি হবে। তৎকালীন পর্ষদের কয়েকজন সদস্য ইতিবাচক মনোভাব দেখালে রাজি হন সভাপতি। সেই জমিতে থাকা কয়েক দোকানের ব্যবসায়ীকে ছয় লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে জমি কিনে নেয় এফবিসিসিআই। আনিসুল হকের পর সংগঠনের দায়িত্ব নেন হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ। তাঁর মেয়াদের শেষ দিকে ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এ কে আজাদের পরবর্তী সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহ্‌মদ ভবন নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করেন। ইতিমধ্যে সরকারের কাছ থেকে ভবন নির্মাণের জন্য ২০ কোটি টাকার বরাদ্দও চলে আসে।

ভবন নির্মাণের আগে নকশা অনুমোদনের জন্য রাজউকে আবেদন করলেও কেপিআইয়ের বিধিনিষেধের কারণে তা আটকে যায়। ভবনটির অদূরে বঙ্গভবন হওয়ায় ১২ তলার ওপরে ভবন করার অনুমতি মিলছিল না। অন্যদিকে সরকারি বরাদ্দের টাকা ফেরত যাবে, এই শঙ্কায় তড়িঘড়ি করে কাজ শুরু করেন তৎকালীন নেতারা।

সংগঠনের সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিনের সময় সরকারের উচ্চপর্যায়ে তদবির ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বেশ কয়েকবার বৈঠক করে কেপিআইয়ের বাধ্যবাধকতা থেকে ছাড় পেতে চেষ্টা করা হয়। সেই প্রক্রিয়া শেষ করে নকশা পাসের কাজটি সম্পন্ন করেন এফবিসিসিআইয়ের বর্তমান সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম।

শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ভবন নির্মাণের পর ব্যবহার করা যাচ্ছে না। আমি সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর বিষয়টির গভীরে গিয়ে খোঁজ করতেই দেখলাম কেপিআইয়ের জটিলতায় নকশা পাস হচ্ছে না। এরপর উদ্যোগ নিলাম। তিনি বলেন, ‘আমাদের যাঁরা ক্ষমতায় যান, তাঁদের অনেকের মধ্যে আইন না মানার প্রবণতা রয়েছে। পরের সভাপতি এসে সেভাবে বিষয়টিকে এগিয়ে নেন না। ফলে জটিলতা হয়।’

ব্যবসায়ী সংগঠনের মধ্যে অনুমোদন না নিয়ে ভবন নির্মাণ করার নজির এটিই প্রথম নয়। এর আগে হাতিরঝিলে জলাধার আইন লঙ্ঘন করে দুই তলা বেসমেন্টসহ ১৬তলা ভবন নির্মাণ করেছিল বিজিএমইএ। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল হাইকোর্ট এক রায়ে ভবনটিকে ‘হাতিরঝিল প্রকল্পে একটি ক্যানসারের মতো’ উল্লেখ করে ভেঙে ফেলতে নির্দেশ দেন। বর্তমানে ভবনটি ভাঙার কাজ শেষের দিকে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, এফবিসিসিআইয়ের খারাপ দৃষ্টান্ত তৈরি করা উচিত হয়নি। ভবন নির্মাণে যদি মাস্টারপ্ল্যানের কোনো বিচ্যুতি না হয়, তাহলে ১০ গুণ জরিমানা নিয়ে রাজউক নকশার অনুমোদন দিতে পারে। কেপিআইয়ের বাধ্যবাধকতার কারণে নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা ছেড়ে ভবন নির্মাণ করতে হয়। এফবিসিসিআই এসব পরিপালন করছে কি না, সেটি রাজউক বলতে পারবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজউকের একজন পরিচালক গতকাল বলেন, হাটখোলায় এফবিসিসিআইয়ের ভবনের কিছু ত্রুটি–বিচ্যুতি ছিল। তবে সরকারের টাকায় ভবনটি নির্মিত হওয়ার কারণে গত বছর নকশার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।