আবারও আসছে গতানুগতিক বরাদ্দের স্বাস্থ্য বাজেট

আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের জন্য সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ছে।

টিকা কেনা, করোনাভাইরাস ঠেকাতে হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের জন্য সরঞ্জাম কেনা, কেনাকাটায় অনিয়ম ও দুর্নীতি ইত্যাদি কারণে এ বছরের এবং বাজেটের আলোচিত খাত ‘স্বাস্থ্য খাত’। এই খাতের জন্য আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। তবে স্বাস্থ্য খাতকে পাল্টে দেওয়ার মতো কোনো দিকনির্দেশনা থাকছে না আগামী অর্থবছরেও। অথচ সব পক্ষেরই দাবি, স্বাস্থ্য খাতের ওপর পূর্ণ মনোযোগ দেওয়ার এটাই উপযুক্ত সময়।

যদিও চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের মূল বাজেট থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। সে হিসেবে আগামী বাজেট ও মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)—উভয় দিক থেকেই স্বাস্থ্য খাতের হিস্যা বাড়ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বছর ঘুরলে অন্য সব বারের মতো বাজেটে টাকার অঙ্ক যেমন বাড়ে, গতানুগতিকভাবে এবারও তা-ই বাড়ছে। স্বাস্থ্য খাত নিয়ে কোনো মহাপরিকল্পনা থাকছে না এবারও। চলতি অর্থবছরে ১০ হাজার কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল রাখা হয়েছিল স্বাস্থ্য খাতের জন্য। একই আকারের তহবিল রাখা হচ্ছে আগামী অর্থবছরের জন্যও।

যেখানে যত বরাদ্দ

চলতি অর্থবছরে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বিশেষ সম্মানী বাবদ চলতি অর্থবছরে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। এ থেকে গত এপ্রিল পর্যন্ত ৪৯ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। আগামী অর্থবছরেও এ বিষয়ে ১০০ কোটি টাকাই রাখা হচ্ছে।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিতে সরাসরি নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীসহ মাঠ প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী ও প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা মারা গেলে বা কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হলে ক্ষতিপূরণ পাবেন। গত বছর এ নিয়ে পরিপত্র জারি করেছিল অর্থ বিভাগ। এ জন্য চলতি অর্থবছরের বাজেটে ৭৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। এ বরাদ্দ থেকে ৬০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে গত এপ্রিল পর্যন্ত। আক্রান্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া থেকে সরকার বিরত থাকছে, দেওয়া হচ্ছে শুধু মৃতদের পরিবারকে। তারপরও আগামী অর্থবছরে এ ব্যাপারে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ৮০০ কোটি টাকার মতো।

বছরের পর বছর ধরে স্বাস্থ্য খাতের গবেষণা নেই বললেই চলে। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা ছিল। চলতি অর্থবছরে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয় ‘সমন্বিত স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন তহবিল’ বাবদ। কিন্তু অর্থ বিভাগ ও স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগ নীতিমালা প্রণয়ন করতে করতেই বছর পার করছে। যদিও চলতি মাসে এ ব্যাপারে গবেষণা আহ্বান করে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। প্রক্রিয়া শেষ হতে হতে চলতি অর্থবছর শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু কোনো অর্থ খরচ হবে না। তবে নতুন দুই হাজার চিকিৎসক, ছয় হাজার নার্স ও ৭৩২ জন স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। এ জন্য ৫০০ কোটি টাকার মতো বরাদ্দ রাখা হচ্ছে।

স্বাস্থ্য ও পুষ্টিসেবা ব্যবস্থার উন্নয়নে চলতি অর্থবছরে ৪ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। আগামী বাজেটে তা বাড়িয়ে ৬ হাজার কোটি টাকা করা হচ্ছে বলে সূত্রগুলো জানায়। স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রগুলোতে আধুনিক সেবা ও অনলাইনে বিশেষায়িত সেবার মান বাড়াতে বরাদ্দ চলতি অর্থবছরের ১৩৪ কোটি থেকে বাড়িয়ে ২০০ কোটি টাকা করা হচ্ছে।

স্বাস্থ্য বাজেট নিয়ে অর্থ বিভাগের দায়িত্বশীলদের কেউই কথা বলতে রাজি হননি। তবে সাবেক অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য খাত নিয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে, তারা টাকা খরচ করতে পারে না। অনিয়ম তো আছেই। টাকা খরচের দক্ষতা বৃদ্ধির দিকে তাদের নজর দিতে হবে। এ জন্য দরকার জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা ও প্রশিক্ষণ।

টাকা নেই তো চিকিৎসাও নেই

নিম্নমধ্যম আয় থেকে মধ্যম আয়ের দেশের দিকে যাত্রা শুরু করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু সবার জন্য স্বাস্থ্য অর্থাৎ সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি এখনো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, যে স্বাস্থ্যব্যবস্থার আওতায় নাগরিকেরা আর্থিক অসচ্ছলতা থেকে মুক্ত না হয়েও স্বাস্থ্যসুবিধা পেতে পারেন, সেটাই হচ্ছে সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা।

৯ বছর আগে ২০১২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বা ইউনিভার্সেল হেলথ কভারেজ (ইউএইচসি) সংক্রান্ত প্রস্তাবে স্বাক্ষর করে এসেছে বাংলাদেশ। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসেও নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ইউএইচসির পক্ষে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ তথ্যভান্ডার অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ হচ্ছে সেই দেশ, যে দেশে রোগীদের পকেটের টাকায় চিকিৎসা খরচ হয় সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে চিকিৎসাসেবায় সরকারের খরচ হয় ২৬ শতাংশ, আর বাকি ৭৪ শতাংশ খরচই হয় রোগীদের পকেটের পয়সায়।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় ২০১২ সালে ২০ বছর মেয়াদি (২০১২-৩২) স্বাস্থ্য খাতের জন্য একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করেছিল। এতে বলা হয়েছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় কমিয়ে ৩২ শতাংশ করা হবে। তখন ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ছিল ৬৪ শতাংশ। ২০১৫ সালে তা বেড়ে হয় ৬৭ শতাংশ। আর এখন তা ৭৪ শতাংশ হয়ে গেছে। অর্থাৎ ১ লাখ টাকা চিকিৎসা ব্যয়ের মধ্যে ৭২ হাজার টাকা নিজের না থাকলে রোগী চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত থাকবেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ডাক্তার দেখানো, রোগের পরীক্ষা করানো, ওষুধ কেনা এবং ডাক্তার ও নার্সের সেবা পাওয়া—এগুলোই চায় মানুষ। কিন্তু আশানুরূপ পায় না। এসব পাওয়া মানুষের ন্যায্য অধিকার। টাকা না থাকলে চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর বিষয়টি তো আছেই, এমনকি টাকা দিয়েও অনেক সময় চিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁর মত, ‘সরকার যদি মনে করে দেশের চিকিৎসা খাতকে সত্যিকার অর্থেই বদলে দেবে, সেটা অসম্ভব নয়। তবে মনে করায় খাদ থাকলে তা সম্ভবও নয়। ৩৩ হাজার কেন, ৯০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও সম্ভব নয়। যে চিকিৎসা দেশেই আছে, রাজনীতিবিদ ও আমলাদের সে চিকিৎসা দেশেই নিতে হবে—সর্বোচ্চ মহল থেকে যদি এমন কোনো বার্তা দেওয়া হয়, তাহলে মনে হয় স্বাস্থ্যব্যবস্থার কিছুটা উন্নতি আশা করা যাবে।’

চিকিৎসা করতে গরিব হতে হচ্ছে

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের ১১টি দেশ নিয়ে ‘হালনাগাদ ২০১৯’ নামে যে তথ্য প্রকাশ করে, তাতে দেখা যায় চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতিবছর বাংলাদেশের ১ কোটি ১৪ লাখের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের ওপর এই চাপ বৃদ্ধির কারণ হচ্ছে স্বাস্থ্যের জন্য রাষ্ট্রীয় আর্থিক নিরাপত্তাব্যবস্থা দুর্বল। ডব্লিউএইচওর মতে, বাংলাদেশের প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষকে ‘আকস্মিক স্বাস্থ্য ব্যয়ের’ চাপ সামলাতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে একটি পরিবার তার মোট ব্যয়ের ১০ শতাংশ ব্যয় করছে শুধু স্বাস্থ্যের পেছনে। অগ্রাধিকার ঠিক করে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ না বাড়ানোর কারণেই এ রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য খাতে কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার। স্থানীয় থেকে জাতীয়—সব পর্যায়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় সংস্কার আনতে হবে। এ জন্য আপাতত একটি টাস্কফোর্স ও পরে জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন গঠন করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের আরেক অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমত, সব নাগরিকের নিবন্ধিত সাধারণ ডাক্তার থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিশেষজ্ঞ হাসপাতালের সঙ্গে নিবন্ধিত সাধারণ ডাক্তারের মাধ্যমে সংযোগ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। আর এ ব্যবস্থা চালু করতে জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে জন্ম, মৃত্যু, আয়-ব্যয়সহ নাগরিকের প্রয়োজনীয় সব তথ্য-উপাত্তের ডিজিটাল তথ্যভান্ডার তৈরি করতে হবে।

সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে না ওঠার পেছনে রাজনীতিবিদ ও আমলাদেরও দায় রয়েছে বলে মনে করেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার পরিমাণ বিদেশে চলে যায়। এটা রোধ করতে হবে। তার প্রশ্ন, কিন্তু কে রোধ করবে।