আসবাব রপ্তানিতে চীনের কাছাকাছি পৌঁছাতে চাই

সরকার আসবাবসহ পাঁচটি খাতকে গুরুত্ব দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এরই মধ্যে ঢাকায় গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হলো ফার্নিচার ও গৃহসজ্জার পণ্যসামগ্রীর প্রদর্শনী। আসবাব খাতের সম্ভাবনা, সমস্যাসহ সার্বিক অবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্প মালিক সমিতির চেয়ারম্যান ও হাতিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম এইচ রহমান

সেলিম এইচ রহমান
সেলিম এইচ রহমান

প্রথম আলো: আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের আসবাবের সম্ভাবনা কতটুকু?
সেলিম রহমান: সস্তা শ্রমই বাংলাদেশকে এগিয়ে রাখবে। কারণ, অনেক দেশে এখন আসবাব তৈরির লোকবল খুব একটা পাওয়া যাচ্ছে না। আবার যাদের পাওয়া যায়, তাদের অনেক অর্থ দিতে হয়। যা কিনা বাজারে টিকে থাকার জন্য সহায়ক নয়। বরং বাজার ধরে রাখতে সবাইকে কম দামের দিকেই যেতে হবে। বিশ্বে বর্তমানে অনেক ধরনের আসবাব তৈরি হয়। যন্ত্রের এক পাশ দিয়ে কাঁচামাল দিলেই অন্য দিক দিয়ে রেডিমেড আসবাব বের হয়ে আসে। এর পাশাপাশি হাতের স্পর্শ আছে এমন আসবাবের ভালো চাহিদা আছে। আর এগুলো ঐতিহ্যগতভাবেই করে আসছি আমরা। একটি উদাহরণ দিলেই পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। বিশ্বে আসবাব রপ্তানিতে শীর্ষস্থানটি চীনের। তবে তাদের একজন সাধারণ শ্রমিককের মাসিক মজুরি বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৫ হাজার টাকার সমান। এ কারণে দেশটি আসবাব খাত থেকে সরে উচ্চপ্রযুক্তির পণ্য তৈরির দিকে যাচ্ছে। আমাদের একজন আমেরিকান ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান আছে, যারা আগে চীন থেকে হাতে তৈরি আসবাব কিনত। এখন তাদের কাছে আমরা মাসে গড়ে আট কনটেইনার পণ্য রপ্তানি করি। এসব আসবাব যন্ত্র দিয়ে তৈরি হয় না, বরং মানুষের অংশগ্রহণই বেশি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই চীনের মতো দেশ এসব পণ্যের বাজার হারিয়ে ফেলছে। তাই সবকিছু ঠিকঠাকভাবে এগোলে আমরা আগামী ১০ বছর পর আসবাব রপ্তানিতে চীনের কাছাকাছি পৌঁছে যেতে চাই।


প্রথম আলো: আসবাব রপ্তানির বিশ্ব বাজার কত বড়? বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান কী?
সেলিম রহমান: রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর দেওয়া তথ্যমতে, গত ২০১৩ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ১৪ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের আমদানি এবং রপ্তানি করেছে ১৪ হাজার ৮৬৪ কোটি ডলারের আসবাব। অবশ্য এ ক্ষেত্রে আমাদের অংশীদারত্ব এখনো খুবই কম। গত অর্থবছর আমরা রপ্তানি করেছি ৪ কোটি ২৫ লাখ ডলার, দেশীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৩৪০ কোটি টাকার সমান।
বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের সব কটি দেশ, আমেরিকা, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় আসবাব রপ্তানি করছে দেশের ১৭টি প্রতিষ্ঠান। এদিকে বড় বড় প্রতিষ্ঠান সম্ভাবনাময় এ খাতে নতুন বিনিয়োগ করছে। ইতিমধ্যে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ রিগ্যাল ফার্নিচার নিয়ে এসেছে। ওয়ালটন আসবে বলে শোনা যাচ্ছে। এ ছাড়া বড় ব্র্যান্ডগুলোকে দেখে মাঝারি মানের প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্যের মান উন্নয়নে এগিয়ে আসছে। এটি খুবই ইতিবাচক।


প্রথম আলো: আসবাব রপ্তানিতে বর্তমানে বড় বাধা কী?
সেলিম রহমান: দেশে বনাঞ্চল কম, তাই কাঠ আমদানির ওপরই সবাইকে নির্ভর করতে হয়। তবে কাঠে ১০ শতাংশ, প্লেইন ও ভিনিয়ার্ড বোর্ডে ৩৫ থেকে ৮০ শতাংশ ও ফেব্রিকস আমদানিতে ১০২ শতাংশ শুল্ক ও কর দিতে হয়। কাঠের শুল্ক ও কর মোটামুটি যৌক্তিক হলেও বোর্ড ও ফেব্রিকসেরটা অনেক বেশি। বর্তমানে এটাই বড় বাধা। কারণ, অনেক আসবাবে কাঠের চেয়ে বোর্ডের ব্যবহার বেশি হয়। এতে করে আমাদের পণ্যের দাম যায় বেড়ে, প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাই আমরা। এ জন্য সরকারের কাছে ২৫ শতাংশ নগদ সহায়তা দাবির পাশাপাশি কাঠ, বোর্ড ও ফ্রেব্রিকসের আমদানি শুল্ক কমিয়ে যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসার দাবি জানিয়েছে।
প্রথম আলো: আসবাবের শ্রমিকদের দক্ষ করার জন্য দেশে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নেই। এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি? ইপিবি চার বছর ধরে দেশে আসবাবের প্রদর্শনী করছে। এতে কীভাবে লাভবান হচ্ছেন উদ্যোক্তারা?
সেলিম রহমান: বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি আসবাবশিল্পে শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়ানোটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বিদেশি ক্রেতারা পণ্য ক্রয়ের আগে আমাদের সক্ষমতা দেখেন। সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোর পাঠ্যক্রমে আসবাবের বিষয়টি যুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা এ ব্যাপারে কয়েক দফা মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রকল্পের আওতায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে ফার্নিচারশিল্প মালিক সমিতি শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়ানোর একটি উদ্যোগ নিয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় সারা দেশের তিন হাজার শ্রমিককে ১২ দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। আগামী মাসে এটি শুরু হবে।
প্রদর্শনীর আয়োজন খুবই ইতিবাচক। এ সুযোগে ক্রেতারা আমাদের পণ্যের পাশাপাশি কারখানা ঘুরে দেখার সুযোগ পান। এ ক্ষেত্রে সক্ষমতা থাকলে উদ্যোক্তাদের ক্রয়াদেশ পাওয়া সুযোগ হয়।


প্রথম আলো: বড় ব্র্যান্ডগুলো নিত্যনতুন নকশা ও উন্নত মানের কারণে দেশের আসবাব বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তবে দাম অনেক ক্ষেত্রেই মধ্য আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে। এ বিষয়ে আপনারা কোনো উদ্যোগ নেবেন?
সেলিম রহমান: কাঠ থেকে শুরু করে আসবাবের অধিকাংশ কাঁচামালই আমদানি করতে হয়। এসব পণ্যের উচ্চ আমদানি শুল্ক দাম বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ। তা ছাড়া আমাদের সবাই সব ধরনের আসবাব তৈরি করে। এটাও একটা সমস্যা। উন্নত দেশে প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান সারা বছর একটি নির্দিষ্ট পণ্যই তৈরি করে। যেমন—যারা খাট তৈরি করে, তারা শুধুই খাটই বানায়। এতে একটি পণ্যের উৎপাদনে তাদের বিশেষ দক্ষতা হয়। একই সঙ্গে তা পণ্যের মূল্য কমানোর বিষয়ে সহায়তা করে। কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক কমানোর বিষয়ে আমরা সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করছি। এটি হয়ে গেলে পণ্যের দাম কিছুটা হলেও কমার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন: শুভংকর কর্মকার