ই-ভ্যালির ব্যবসা খতিয়ে দেখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে কমিটি

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ডিজিটাল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ই-ভ্যালির কার্যক্রম খতিয়ে দেখতে তৎপর হয়েছে। গতকাল বুধবার তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এফটিএ অনুবিভাগের যুগ্ম সচিব মো. আবদুছ সামাদ আল আজাদ।

জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব মো. জাফরউদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কমিটি কাজ শুরু করেছে। আমরা ই-কমার্সের ভালো চাই। তবে সবার আগে চাই গ্রাহক যাতে প্রতারিত না হন, সেই ব্যবস্থা। কমিটির প্রতিবেদনে যথাযথ সুপারিশ উঠে আসবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’

এর আগের দিন, গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন ই-ভ্যালি ডটকম লিমিটেডকে চিঠি দিয়েছে। ই-ভ্যালি তার গ্রাহকদের ৮০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত অস্বাভাবিক ক্যাশব্যাক অফার দিচ্ছে বলে বাজারে একচেটিয়া কারবারের (মনোপলি) অবস্থা তৈরি হতে যাচ্ছে এবং প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব বিস্তার হওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করেছে প্রতিযোগিতা কমিশন। এ ছাড়া কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার্ডে ই-ভ্যালির পণ্য কেনার কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করছে।

কমিটি কাজ শুরু করেছে। আমরা ই-কমার্সের ভালো চাই। তবে সবার আগে চাই গ্রাহক যাতে প্রতারিত না হন, সেই ব্যবস্থা।
মো. জাফরউদ্দীন, বাণিজ্যসচিব

প্রতিযোগিতা কমিশন প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এ পর্যন্ত ই-ভ্যালির লেনদেন, আয়-ব্যয়সহ কোম্পানির বিস্তারিত বিবরণ, ই-ভ্যালির আওতাভুক্ত পণ্যগুলোর বিবরণ, ই-ভ্যালির পণ্যের ভৌগোলিক সীমানার বিবরণ, ই-ভ্যালির মাধ্যমে যেসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ব্যবসা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে, তাদের তালিকা ও ব্যবসায়িক লেনদেনের পদ্ধতি ও শর্তাবলি জানতে চেয়েছে।

কমিশন আরও জানতে চেয়েছে, ৮০-১৫০ শতাংশ ছাড় দিয়ে ব্যবসা করার তথ্য, ঈদ ধামাকা অফারের সঙ্গে অন্যান্য অফারের পার্থক্যের বিস্তারিত বিবরণ; ঈদ ধামাকা অফার সময়ের আগের তিন মাসের বিক্রি, আয় ও মুনাফার সঙ্গে অফার চলাকালীন বিক্রি, আয় ও মুনাফার তুলনামূলক বিবরণী।

ই-ভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল এ নিয়ে গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেসব তথ্য চাওয়া হয়েছে, তা আমরা প্রস্তুত করছি। ব্যবসায় আমরা স্বচ্ছ আছি, স্বচ্ছই থাকতে চাই। আশা করছি সবাইকে আমরা বোঝাতে সক্ষম হব যে আমরা ঠিক পথেই আছি।’

অস্বাভাবিক অফার দিয়ে বাজারে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করা বেআইনি। ই-ভ্যালি এ রকম প্রভাব বিস্তার করছে কি না বা এত ছাড় দিয়ে কীভাবে ব্যবসা করছে, আমরা জানতে চেয়েছি।
মো. মফিজুল ইসলাম, প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন

প্রতিযোগিতা আইনের ১৬ ধারায় একচেটিয়া বাজার তৈরিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পণ্য বা সেবা কেনাবেচার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অন্যায্য বা বৈষম্যমূলক শর্ত আরোপ করে আগ্রাসী মূল্য নির্ধারণ করা যাবে না। কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ই-ভ্যালি এই ধারা লঙ্ঘন করছে।

প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপারসন মো. মফিজুল ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘অস্বাভাবিক অফার দিয়ে বাজারে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করা বেআইনি। ই-ভ্যালি এ রকম প্রভাব বিস্তার করছে কি না বা এত ছাড় দিয়ে কীভাবে ব্যবসা করছে, আমরা জানতে চেয়েছি। তদন্তে বেআইনি কিছু উঠে এলে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।’

বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন ই-ভ্যালির পাশাপাশি মঙ্গলবার ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশকেও (ই-ক্যাব) আলাদা চিঠি দিয়েছে। কমিশন এতে ই-ভ্যালির যাবতীয় তথ্য, ই-ভ্যালির প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা ও ই-ক্যাবের ভূমিকা জানতে চেয়েছে। কমিশন এ ছাড়া জানতে চেয়েছে দেশের অনলাইন মার্কেটপ্লেসের তালিকা এবং সবচেয়ে বেশি আয় করা ২০টি অনলাইন মার্কেটপ্লেসের বার্ষিক লেনদেন, আয়-ব্যয় ও মার্কেট শেয়ারের কথাও। ই-ক্যাবকে এসব তথ্য জমা দিতে ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়েছে।

ই-ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিযোগিতা কমিশনের চাওয়া তথ্য আমরা ই-ভ্যালির কাছে জানতে চেয়েছি। আশা করছি যথাসময়ে পাব এবং কমিশনকে জানিয়ে দেব।’ সুষ্ঠু ই-কমার্স ব্যবসার স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, প্রতিযোগিতা কমিশনসহ সব পক্ষের সমন্বয়ে শিগগির একটি বৈঠক হবে বলেও জানান তিনি।

কার্ডে লেনদেন সাময়িক স্থগিত
২৪ আগস্ট প্রথম আলোয় ‘ডিজিটাল ব্যবসার নতুন ফাঁদ ই-ভ্যালি’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পরদিন মঙ্গলবার কয়েকটি ব্যাংক তাদের কার্ডে ই-ভ্যালির পণ্য কেনাকাটা স্থগিত করেছে।

গতকাল পর্যন্ত বেসরকারি ব্র্যাক ব্যাংক ও দি সিটি ব্যাংক এবং লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের কার্ডে লেনদেন সাময়িক স্থগিত করেছে। তিনটি প্রতিষ্ঠানই তাদের গ্রাহকদের মুঠোফোনে খুদে বার্তা (এসএমএস) দিয়ে জানিয়েছে, পরবর্তী নোটিশ না দেওয়া পর্যন্ত কার্ডের মাধ্যমে ই-ভ্যালির পণ্য কেনার ক্ষেত্রে চলমান ডিসকাউন্ট সুবিধা বন্ধ থাকবে।

যোগাযোগ করলে ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চাই না আমাদের গ্রাহকেরা সামান্যতমও ঝুঁকির মধ্যে থাকুন। তবে অনুসন্ধান শেষে একটি সুন্দর সমাধানের পথ বের হলে অবশ্যই আমরা স্থগিতাদেশ তুলে নেব।’

এদিকে যৌথ মূলধনি কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয় (আরজেএসসি) সূত্রে গতকাল জানা গেছে, প্রতিষ্ঠাকালীন অনুমোদিত মূলধন ৫ লাখ টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ৫০ হাজার টাকা হলেও গত মার্চে ই-ভ্যালি তার মূলধন বাড়িয়েছে। বর্তমানে এর অনুমোদিত মূলধন ১০ কোটি এবং পরিশোধিত মূলধন ১ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর সামগ্রিক বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ই-ভ্যালির বিপণনের ধরন নিয়ে বহু আগেই প্রশ্ন উঠেছে। ১০০-১৫০ শতাংশ অফার বাজারে সুস্থ প্রতিযোগিতার জন্য হুমকিস্বরূপ। তবে প্রতিযোগিতা কমিশন দেরিতে হলেও কোম্পানিটিকে চিঠি দিয়েছে এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করেছে বলে সাধুবাদ জানাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘অগ্রিম টাকা নেওয়াটাই বড় সমস্যা। আমার মনে হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নিয়ে কিছু করা উচিত।’