ইউরোপের রাস্তায় বাংলার সাইকেল

মেঘনার কারখানা পরিদর্শনে আসা ইইউ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলাপরত মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান ভূঁইয়া (ডানে)
ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর তেজগাঁওয়ের ছোট একটা কারখানা থেকে যাত্রা শুরু। সেটি ১৯৭৬ সালে। শুরুতে সাইকেলের স্পোক, রিম ইত্যাদি তৈরি হতো কারখানায়। পরে সেটির পরিধি বাড়ে। বাইসাইকেলের স্পোক, রিমসহ নানা সরঞ্জামের ব্যবসা শুরু করেছিলেন চিকিৎসক আবদুল খালেক। তাঁর হাত ধরেই সাইকেলের ব্যবসার শুরু মেঘনা গ্রুপের। পরে তাঁর সন্তান মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ভূঁইয়ার চেষ্টা ও উদ্যোগে সাধারণ ব্যবসাটি হয়ে ওঠে শিল্প। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় ইউরোপের ঘরে ঘরে। এখন অপেক্ষা মধ্যপ্রাচ্য জয়ের।

গত মাসের শেষ সপ্তাহে তেজগাঁওয়ে মেঘনা সাইকেলের কার্যালয়ে বসে কথা হয় বাংলাদেশের বাইসাইকেলকে ইউরোপের রাস্তায় পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্নদ্রষ্টা মিজানুর রহমানের সঙ্গে। করোনার এ সময়ে দুবাইয়ে বসে অনলাইনে যুক্ত হয়ে তিনি শোনালেন তাঁর স্বপ্নযাত্রার তিন দশকের গল্প। যে গল্পের শুরুটাও হয়েছিল তেজগাঁওয়ের ছোট্ট এক দোকান থেকে।

মিজানুর রহমানের বাবা আবদুল খালেক পেশায় ছিলেন চিকিৎসক। পাশাপাশি ১৯৬৭ সাল থেকে শুরু করেন ওষুধের ব্যবসা। স্বাধীনতার পর দেশে ওষুধের বড় ধরনের সংকট দেখা দিলে এ ব্যবসা থেকে সরে আসেন। ১৯৭৬ সালে সরকােরর কাছ থেকে তেজগাঁওয়ের সাইকেলের কারখানাটি কিনে নেন। পরে নাম বদলে হয় মেঘনা সাইকেল ইন্ডাস্ট্রিজ।

১৯৮৬ সালে আবদুল খালেক মারা যাওয়ার পর ব্যবসার হাল ধরেন তাঁরই বড় ছেলে মিজানুর রহমান ভূঁইয়া। তাঁর হাত ধরেই মূলত মেঘনার সাইকেলশিল্পের যাত্রা এবং ইউরোপ জয়। মিজানুর রহমান যখন বাবার ব্যবসার হাল ধরেন তখন প্রতিষ্ঠানটি কেবল সাইকেলের স্পোক বানায়। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর স্পোকের পাশাপাশি রিংসহ সাইকেলের অন্যান্য যন্ত্রাংশ বানাতে শুরু করেন। সেই সঙ্গে মনের গহিনে স্বপ্ন বুনতে থাকেন একদিন পরিপূর্ণ সাইকেল বানানোর। আর সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে একটু একটু করে নিজেকে তৈরি করতে শুরু করেন।

বাংলাদেশে তখন পরিপূর্ণ সাইকেল বানাত কেবল সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সাইকেল ইন্ডাস্ট্রিজ। তেজগাঁওয়ে প্রতিষ্ঠিত সরকারি এই প্রতিষ্ঠানের তৈরি প্রিন্স সাইকেল ছিল বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশে তখন বিয়েতে ‘সাইকেল’ উপহার দেওয়ার প্রচলন ছিল। বিয়ের বাজারে সেই ‘প্রিন্স’-এর ছিল খুব কদর। সেই জনপ্রিয়তা দেখে পরিপূর্ণ সাইকেল তৈরির স্বপ্ন আরও বেশি পেয়ে বসে মিজানুর রহমান ভূঁইয়ার। এর মধ্যে যন্ত্রাংশের পাশাপাশি চীন থেকে ফনিক্স সাইকেল আমদানি শুরু করেন। সেটি ১৯৯০ সালে। পুরো ৯০-এর দশক জুড়ে ফনিক্স সাইকেল ছিল বেশ জনপ্রিয়। যন্ত্রাংশ তৈরি আর আমদানি করা ফনিক্স সাইকেল বিক্রি করে ভালোই চলছিল ব্যবসা। ব্যবসা বাড়ছিল ঠিকই কিন্তু স্বপ্ন ছুঁতে পারছিলেন না মিজানুর রহমান। এর মধ্যে ’৯৫ সালে সরকার তেজগাঁওয়ের ‘বাংলাদেশ সাইকেল ইন্ডাস্ট্রিজ’ বিক্রির জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। দেড় একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত সরকারি প্রতিষ্ঠানটি ২ কোটি ২৭ লাখ টাকায় কিনে নেন। সরকারের পটপরিবর্তন হয়। ফলে কারখানাটি বুঝে পেতে বছর দুয়েক লেগে গেল।

মিজানুর রহমান ভূঁইয়া বললেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানটি বুঝে পাওয়ার পর পর দেখলাম যেসব যন্ত্রপাতি আছে সেগুলো প্রায় ব্যবহারের অনুপযোগী। কারখানার আধুনিকায়ন দরকার। তাই নতুন যন্ত্রপাতি আমদানি থেকে শুরু করে পুরোপুরি নতুনভাবে গড়ে তোলা হয় কারখানাটি।

একনজরে

মেঘনা গ্রুপ

সাইকেলের ব্যবসা শুরু

১৯৭৬ সালে

প্রথম রপ্তানি

২০০০ সালে, ইংল্যান্ডে

ব্যবসায়িক ইউনিট

১৪

কর্মী

প্রায় ১০ হাজার

ব্যবসা

সাইকেল ছাড়া পোশাক, গাড়ি, প্যাকেজিং, ওয়াশিং, মেলামাইন

নতুন রূপে, নতুনভাবে নতুন নামে কারখানাটিতে উৎপাদন শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। কারখানার ধরন-ধারণ বদলে গেলেও শুরুতে প্রিন্স ব্র্যান্ডের সাইকেলই উৎপাদন করে। নতুন কারখানায় শুরুতে মাসে সর্বোচ্চ এক হাজারের মতো সাইকেল তৈরি করা হতো। সেগুলো বিক্রির জন্য বংশালে ছিল নিজেদের বিক্রয়কেন্দ্র। তখন একেকটি সাইকেল পাইকারিতে বিক্রি হতো ১ হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার টাকায়।

নতুন কারখানায় উৎপাদন ও বিক্রি ভালোই চলছিল। কিন্তু তিন মাসের মাথায় ধাক্কা খায় মিজানুর রহমানের স্বপ্ন। উৎপাদন শুরুর তিন মাস পার না হতেই বন্ধ করে দিতে হয় উৎপাদন। কারণ চীনের ফনিক্স সাইকেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটি জানায়, স্থানীয় বাজারের জন্য প্রিন্স সাইকেল উৎপাদন করলে ফনিক্সের পরিবেশক থাকা যাবে না। দেশে তখন ফনিক্সের সাইকেলের জমজমাট ব্যবসা। তাই ফনিক্সের শর্ত মেনে নিয়ে উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়।

মিজানুর রহমান বলেন, পরিপূর্ণ সাইকেল বানানোর স্বপ্নপূরণের জন্য সরকারি সাইকেল কারখানাটি কিনেছিলাম। কিন্তু উৎপাদন শুরু করার তিন মাসের মাথায় চীনের প্রতিষ্ঠানটির কারণে উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হয়। খুব মন খারাপ হয়। কিন্তু হাল ছাড়িনি। মনে মনে নিজেই সংকল্প নিই, যেকোনোভাবেই হোক উৎপাদন করবই। তখনই রপ্তানির বিষয়টি মাথায় আসে। রপ্তানির বাজার ও উপায় খুঁজতে থাকি। ব্যবসার হাল ধরার পর থেকে বিদেশে সাইকেলসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মেলায় নিয়মিতই অংশ নিতে যেতাম। তাতে বিদেশি বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে। সেই যোগাযোগই তাঁকে পথ দেখায় রপ্তানির বাজারের।

মিজানুর রহমানের মেঘনা সাইকেল ইন্ডাস্ট্রিজ প্রথম রপ্তানি আদেশ পান ১৯৯৯ সালে। সেটি ইংল্যান্ডের পূর্বপরিচিত এক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। প্রথম দফায় প্রতিষ্ঠানটি ২ হাজার সাইকেলের ক্রয়াদেশ দেয়। প্রতি সাইকেলের দাম ঠিক হয় ২৯ মার্কিন ডলার। বেশ উৎসাহ নিয়ে রপ্তানির প্রথম চালান তৈরির পর ঝামেলা বাধে জাহাজীকরণের আগের দিন। চূড়ান্ত মান যাচাইয়ে ধরা পড়ে রপ্তানির জন্য তৈরি সাইকেলের বেশ কিছুতে রঙের সমস্যা হয়েছে।

সাইকেলে ত্রুটি দেখে প্রথম চালানটি নিজে থেকেই বাতিল করে দিলেন মিজানুর রহমান। বললেন, ‘ক্রেতার পক্ষে নিযুক্ত প্রতিনিধি এসব পণ্য গ্রহণে সম্মতি জানিয়েছিলেন। কিন্তু আমি পাঠাতে রাজি হইনি। কারণ, শুরু থেকে মানের প্রশ্নে আমি আপসহীন থাকতে চেয়েছি। আমি চাইনি, বাংলাদেশের পণ্যের মান বিদেশিদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হোক।’

প্রথম চালান পাঠানো নিজে থেকে বাদ দেওয়ার পর ওই ক্রয়াদেশের বিপরীতে একই ক্রেতার কাছে ২০০০ সালের জুনে সমপরিমাণ সাইকেল রপ্তানি করা হয়। রপ্তানির সেই শুরু। আর পেছনে থাকতে হয়নি। মিজানুর রহমান বলেন, ত্রুটির কারণে রপ্তানির প্রথম চালানটি নিজে থেকে বাদ দেওয়ার পর ক্রেতার কাছে আমাদের প্রতিষ্ঠানের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেড়ে যায়। তাতে আমাদেরও আত্মবিশ্বাস বাড়ে। বর্তমানে আয়ারল্যান্ড, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, ডেনমার্ক, জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয় বাংলাদেশে তৈরি মেঘনার সাইকেল। এর মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি সাইকেল রপ্তানি হয় জার্মানিতে। এর বাইরে ভারতেও মেঘনার সাইকেল রপ্তানি হচ্ছে।

বর্তমানে মেঘনার সাইকেল রপ্তানির বার্ষিক লেনদেন বা টার্নওভার ২০ কোটি মার্কিন ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। ২০০০ সালে প্রথম রপ্তানি চালানে প্রতিটি সাইকেলের দাম ছিল মাত্র ২৯ মার্কিন ডলার। আর এখন প্রতিটি সাইকেলের সর্বনিম্ন গড় রপ্তানিমূল্য ১৮০ ডলার। মিজানুর রহমানের পরিকল্পনা ভবিষ্যতে তিনি আরও বেশি দামি সাইকেল রপ্তানির। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে ব্যবসা সম্প্রসারণ করা। বললেন, কিছু করতে হলে আগে স্বপ্ন দেখতে হয়। আর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে লাগে একাগ্রতা ও পরিশ্রম। এই দুটোই মেঘনার আজকের সাফল্যের মূলমন্ত্র। এখন তাই বলতে পারি, ভবিষ্যতের স্বপ্ন আমরা দেখছি, সেটির বাস্তবায়নে অপেক্ষা শুধু সময়ের।

সাইকেলের ব্যবসা বড় হওয়ার পাশাপাশি পোশাক, প্যাকেজিং, টায়ার, টিউব, গাড়ির ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত প্রতিষ্ঠানটি। সব মিলিয়ে মেঘনার ব্যবসা ইউনিটের সংখ্যা ১৪টি। আর এসব ইউনিটে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ১০ হাজার লোকের। রপ্তানি বাজারের সাফল্যের পর দেশের বাজারেও সাইকেল বাজারজাত শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এ জন্য মিজানুর রহমানের বড় ছেলে মাহিনের নামে কোম্পানি গঠন করা হয়েছে। দেশের বাজারে কোম্পানিটির ভেলোস সাইকেল বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। দেশের বাজারে নিজেদের ব্যবসা শুরু করায় ২০১১ সালে চীন থেকে ফনিক্স সাইকেল আমদানি বন্ধ করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি।

মিজানুর রহমান বলেন, পোশাকের বাইরে সাইকেল রপ্তানিতে বিদেশে আমরা ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ডটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে কাজ করছি। সরকারের প্রয়োজনীয় সমর্থন পেলে পোশাকের মতো
সাইকেলও শক্তিশালী রপ্তানি খাত হয়ে উঠবে। কারণ, বিশ্ববাজারে সাইকেলের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। করোনা এসে বিশ্ববাজারে সাইকেলের চাহিদা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

বর্তমানে ইউরোপের বাজারে সাইকেল রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। মেঘনার দেখানো পথ ধরে আলিটা বিডি, করভো, প্রাণ-আরএফএলসহ কয়েকটি কোম্পানি সাইকেল রপ্তানি করছে। গত ৩০ জুন সমাপ্ত ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৩ কোটি ৮ লাখ ডলারের বাইসাইকেল রপ্তানি হয়েছে। আগের অর্থবছর রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮ কোটি ২৮ লাখ ডলার। সেই হিসাবে গত বছরে বাইসাইকেল রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ৫৮ শতাংশের বেশি।

বাইসাইকেলের মতো প্রকৌশল পণ্য রপ্তানিতে পথ দেখানো মিজানুর রহমান খানিকটা আড়ালেই কাজ করতে পছন্দ করেন। তাঁর মতো আরও অনেক মিজানের কারণে আজ বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে চলছে। মেঘনার জয় হোক! সঙ্গে অবশ্যই বাংলাদেশের।


সুজয় মহাজন : প্রথম আলোর বাণিজ্য সম্পাদক