ইন্টারনেটের খরচ বাড়ানোর আয়োজন

ইন্টারনেট
প্রতীকী ছবি।

ধরা যাক, ময়মনসিংহের স্থানীয় পর্যায়ের একজন ইন্টারনেট গ্রাহক যে টাকায় ও গতিতে গুগল ফেসবুকের কনটেন্ট পেতেন, আগামী দুই মাস পর আর তা পাবেন না। তাঁর খরচ বাড়বে এবং কনটেন্টের ডেটা পেতে গতিও কমবে। কারণ, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায়ের ক্যাশ সার্ভার বন্ধ করার জন্য ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী (আইএসপি) প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে।

গত ১ ফেব্রুয়ারি বিটিআরসি ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দিয়ে স্থানীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে ক্যাশ সার্ভার তুলে নিতে নির্দেশ দেয়। এ জন্য তারা ছয় মাস সময় বেঁধে দেয়। সে হিসেবে আগামী ৩১ জুলাই এ সার্ভার তুলে নেওয়ার শেষ সময়।

ক্যাশ সার্ভার কী

গুগল বা ফেসবুকের মতো টেক জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান তাদের সেবা বাড়াতে এবং দ্রুত ও সহজে সেবা দিতে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ডেটার জন্য ক্যাশ সার্ভার বসিয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের কোনো থানা পর্যায়ের একজন গ্রাহক গুগল বা ফেসবুকে যখন কোনো কনটেন্ট খুঁজবে, তখন তা প্রথমবার এই টেক জায়ান্টদের মূল সার্ভারে গিয়ে হিট করবে। সেখান থেকে ওই ডেটা স্থানীয় ক্যাশ সার্ভারে জমা হবে। এরপর একই কনটেন্ট যদি আবার কেউ খুঁজতে যায়, তখন স্থানীয় সার্ভার থেকেই পাবে। ফলে পুনরায় পুরো নেটওয়ার্ক ব্যবহার করার প্রয়োজন হবে না।

একদিকে ‘এক দেশ এক রেট’ কর্মসূচি, ইউনিয়ন পর্যায়ে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা অন্যদিকে স্থানীয় পর্যায়ে ক্যাশ সার্ভার বন্ধের নির্দেশনা। প্রশ্ন উঠেছে ইন্টারনেটের দাম কি সরকার কমাচ্ছে, না বাড়ানোর আয়োজন করছে।

ক্যাশ সার্ভার বন্ধের নির্দেশনা নিয়ে আপত্তি তুলেছে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট

সরবরাহকারীদের সংগঠন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (আইএসপিএবি)। তারা এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার জন্য বিটিআরসিকে অনুরোধ জানিয়েছে। তারা বলছে, স্থানীয় পর্যায়ে যাঁরা আইএসপি ব্যবসা করেন, তাঁরা ক্ষতির মুখে পড়বেন। আগামীকাল বুধবার বিটিআরসির সঙ্গে আইএসপিএবির অনলাইনে একটি বৈঠক হওয়ার কথা।

আইএসপিএবির সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে বিটিআরসি স্থানীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে ক্যাশ সার্ভার বন্ধ করতে বলেছে। সরকার আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়েতে (আইআইজি) নিরাপত্তা ডিভাইস বসিয়েছে। তাহলে স্থানীয় বা আঞ্চলিক পর্যায়ে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে ক্যাশ সার্ভার বন্ধের কোনো অর্থ দেখি না। নিরাপত্তাজনিত কোনো ইস্যু হলে সরকার তা আইআইজি থেকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ ভ্রমণের সময় হেফাজতে ইসলামের বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সে সময় সরকার কিছু সময়ের জন্য ফেসবুক বন্ধ রেখেছিল। তখন ক্যাশ সার্ভার পর্যন্ত সরকারকে আসতে হয়নি। সরকার আইআইজি থেকেই বন্ধ করতে পেরেছে।

কেন খরচ বাড়বে

ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, সরকারের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হলে ট্রান্সমিশন খরচ বাড়বে, ইন্টারনেটের গতি কমবে এবং গ্রাহক পর্যায়েও খরচ বাড়বে। দেশে যদি ২ হাজার ৪০০ জিবিপিএস ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথ হয়, সেখানে ক্যাশ সার্ভারে স্থানীয় পর্যায়ে গুগল ও ফেসবুকের ট্রাফিক হচ্ছে চার থেকে পাঁচ গুণ। সরকার যেখানে ‘এক দেশ এক রেট’ বলছে, সেখানে ক্যাশ সার্ভার বন্ধ করা হলে স্থানীয় পর্যায়ে ৫০০ টাকায় ১ এমবিপিএসও দেওয়া যাবে না। স্থানীয় পর্যায়ে দেশে ৮০ ভাগের বেশি গুগল ও ফেসবুক ব্যবহৃত হয়।

৬ জুন বিটিআরসি ‘এক দেশ এক রেট’ নামে এক কর্মসূচির আওতায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের দাম বেঁধে দিয়েছে। সেখান মাসে ৫ এমবিপিএসের (মেগাবাইট পার সেকেন্ড) দাম ৫০০ টাকা, ১০ এমবিপিএস ৮০০ টাকা এবং ২০ এমবিপিএস ১ হাজার ২০০ টাকা।

আইএসপিএবি সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সরকার ইউনিয়ন পর্যন্ত ব্রডব্যান্ড লাইন পৌঁছানোর নানান উদ্যোগ নিয়েছে। যদি স্বল্প খরচে ভালো মানের ইন্টারনেট পৌঁছাতে চায়, তাহলে ক্যাশ সার্ভার তুলে নেওয়ার নির্দেশ সরকারি উদ্যোগের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মতে, বিটিআরসি বলছে যে শুধু নেশনওয়াইড আইএসপির কাছে ক্যাশ সার্ভার থাকবে। কিন্তু সব নেশনওয়াইড আইএসপি প্রান্তিক পর্যায়ে নেই। বাংলাদেশে ৩০০-এর বেশি ক্যাশ সার্ভার রয়েছে, যার অর্ধেকের মতো স্থানীয় পর্যায়ে বসানো হয়েছে। গুগল ও ফেসবুক এই সার্ভার দিয়ে থাকে এবং তারাই নিয়ন্ত্রণ করে। নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী থানা বা বিভাগভিত্তিক আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কনটেন্টের জন্য এই ক্যাশ সার্ভারগুলো যদি ওপরের দিকে উঠে আসে, তাহলে এখান থেকে থানাতে যাওয়ার আইএসপিগুলোর খরচ বেড়ে যাবে। আর আইএসপিগুলো সেই খরচ গ্রাহকের কাছ থেকেই তুলবে। পুরো বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য বিটিআরসির তাৎক্ষণিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে তথ্যপ্রযুক্তি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ১৫ বছর আগের কথা যদি চিন্তা করা যায়, তখন আমেরিকার একটি শহরে ফেসবুক, গুগলের যে পারফরম্যান্স ছিল, তা বাংলাদেশে ছিল না। কারণ, ট্রাফিক সব আসত আমেরিকা থেকে। স্থানীয় পর্যায়ে ক্যাশ সার্ভার ছিল না। এরপর এই টেক জায়ান্টগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্যাশ সার্ভার বসায়। পরবর্তী সময়ে তা স্থানীয় আইএসপির কাছে চলে এল। ফলে ব্যান্ডউইডথের খরচও কমে গেল। ক্যাশ সার্ভার গ্রাহকের যত কাছাকাছি থাকবে, ইন্টারনেট ব্যবহারে তার অভিজ্ঞতা তত ভালো হবে। এ জন্য সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো চায় ক্যাশ সার্ভার যত স্থানীয় পর্যায়ে রাখা যায়।

স্থানীয় পর্যায়ে গ্রাহক ভুক্তভোগী হবে উল্লেখ করে সুমন আহমেদ বলেন, নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে ইন্টারনেট দুনিয়ায় খুব বেশি কিছু করা যায় না। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বড় বড় টেক জায়ান্টের যে পরিমাণ ট্রাফিক ও ব্যবসা, সে হিসেবে আরও আগেই বাংলাদেশে তাদের নিজস্ব অবকাঠামো নিয়ে অফিস থাকার কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা শুধু বাংলাদেশে ভ্যাট নিবন্ধন করেছে। এর বেশি তারা করতে চায় না। কারণ, নীতির ঘন ঘন পরিবর্তন। এই টেক জায়ান্টগুলো বিটিআরসির এই সিদ্ধান্তে স্বাভাবিকভাবেই খুশি হবে না। এ দেশে তাদের ব্যবসা করার পরিবেশ নিয়ে জটিলতা বাড়িয়ে দেওয়া হলো। এই নীতি পরিবর্তন তাদেরও খরচের বিষয়। কারণ, সার্ভারগুলো তারা সরবরাহ করে।