‘হাতবাক্সে’ সফল উদ্যোক্তা শাফাত

হাতবাক্সের তৈরি জাতীয় পতাকা, মানচিত্র, আহসান মঞ্জিল, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, সেন্ট মার্টিন, ট্রাক, বাঘসহ বিভিন্ন রেপ্লিকা
ছবি: সংগৃহীত

ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় উদ্যোক্তা মো. শাফাত কাদিরের চাচা যুক্তরাষ্ট্র থেকে তার জন্য উপহার হিসেবে আনেন ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টির’ একটি রেপ্লিকা বা প্রতিরূপ। সে সময় রেপ্লিকা কী জিনিস, তা না বুঝলেও এটা নিয়ে বেশ কৌতূহল জন্মায় শাফাতের মনে। চিন্তা করেন, বড় হয়ে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করে এমন সব পণ্য তৈরি করবেন তিনি। পড়ালেখা শেষ করে তাই এই রেপ্লিকা তৈরিকেই নিজের ব্যবসার উদ্যোগ হিসেবে বেছে নেন শাফাত কাদির।

বর্তমানে ঢাকার আহসান মঞ্জিল, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, কার্জন হল কিংবা সেন্ট মার্টিন—এ ধরনের দর্শনীয় বিভিন্ন স্থাপনা ও স্থানের ছোট্ট প্রতিরূপ তৈরি করেন শাফাত। বানান রিকশা-ট্রাক ইত্যাদির প্রতিরূপও। মার্বেল পাথরে তৈরি হয় এসব পণ্য।

শাফাতের প্রতিষ্ঠানের নাম ‘হাতবাক্স’। চিন্তাটা শাফাতের নিজের হলেও হাতবাক্স প্রতিষ্ঠায় তাঁর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আরও চার উদ্যোক্তা। তাঁরা হলেন মো. রবিউল হোসেন, তানজিনা তারেক, মো. মোরসালিন অনিক ও মো. খায়রুল বাসার। সম্প্রতি রাজধানীর আজিমপুরে হাতবাক্সের কার্যালয়ে কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শাফাত কাদিরের সঙ্গে। এ সময় হাতবাক্সের পথচলার গল্প শোনান তিনি।

হাতবাক্সের কারখানায় কাজ করছেন কর্মীরা।
ছবি: সংগৃহীত

শাফাতের ইচ্ছা ছিল পড়ালেখা শেষ করে বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করবেন। আর বাবা চাইতেন ছেলে হবে সরকারি চাকরিজীবী। কিন্তু স্নাতক চতুর্থ বর্ষে এসে সেই চিন্তার গতিপথ পাল্টে উদ্যোক্তা বনে যান শাফাত কাদির। শাফাত জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনিসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত একটি ব্যবসা প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশ নেন। সেখানে ছোটবেলার সেই রেপ্লিকা বা প্রতিরূপ তৈরির পরিকল্পনাটি উপস্থাপন করলে সবাই বেশ পছন্দ করেন। কিন্তু তখনো পড়ালেখা চলমান থাকায় সেই পরিকল্পনা নিয়ে আর এগোতে পারেননি।

২০১৬ সালের শুরুর দিকে পড়াশোনা শেষে শাফাত কাদির ও তাঁর বন্ধুরা মিলে স্টেশনারি ও গেজেট পণ্য সরবরাহের ব্যবসা শুরু করেন। এই ব্যবসায় মুনাফা ভালো এলেও নিজেদের উদ্যোক্তা পরিচয় সেভাবে তৈরি হচ্ছিল না। তাই ২০১৭ সালের মাঝামাঝি এসে রেপ্লিকা তৈরির ব্যবসায় নামেন তাঁরা।

মাত্র চার লাখ টাকা পুঁজি ও একজন কর্মী নিয়ে শুরু হয় হাতবাক্সের পথচলা। প্রথমে জাতীয় সংসদ ভবন, স্মৃতিসৌধ, কার্জন হল, অপরাজেয় বাংলা ও আহসান মঞ্জিল—এই পাঁচ স্থাপনার ছোট প্রতিরূপ বানান। এসব পণ্য বাজারে আসার পর শুরুতেই খুব ভালো সাড়া মেলে। মাত্র তিন মাসের মধ্যে ‘না লাভ, না লোকসান’ অবস্থায় পৌঁছে যায় শাফাতদের প্রতিষ্ঠান। কিন্তু মাত্র পাঁচটা নকশা নিয়ে শুরু করাতে একপর্যায়ে চাহিদা কমতে থাকে। শাফাত কাদির বলেন, এ অবস্থায় গ্রাহকদের পছন্দ ও চাহিদা অনুসারে পণ্য তৈরিতে বৈচিত্র্য আনার প্রতি মনোযোগী হই। এতে বিক্রি ৪০-৫০ শতাংশ বেড়ে যায়।

হাতবাক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শাফাত কাদিরসহ (বাঁ থেকে প্রথম) অন্য উদ্যোক্তারা
ছবি: সংগৃহীত

প্রথম দিকে ফেসবুকের মাধ্যমে পণ্যের অর্ডার পেত হাতবাক্স। কিন্তু ব্যবসার পরিসর বড় করতে বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানে পণ্যের নমুনা নিয়ে যেতেন উদ্যোক্তারা। পাশাপাশি অংশ নেন বিভিন্ন প্রদর্শনী ও মেলায়। তাতেই ব্যবসার পরিধি বাড়তে থাকে হাতবাক্সের।

বর্তমানে ১২টি শ্রেণিতে প্রায় ২০০ ধরনের পণ্য বানাচ্ছে হাতবাক্স। এর মধ্যে মিনিয়েচার রেপ্লিকা ছাড়াও রয়েছে ফ্রিজ ম্যাগনে ট রেপ্লিকা, বিভিন্ন ধরনের ফ্রেম, পেপার ওয়েট, কার্ড হোল্ডার, ডেস্ক ক্যালেন্ডার, লেপেল পিন, কোট পিন, টাই পিন, কাফলিংক, চাবির রিং, লাগেজ ট্যাগসহ বিভিন্ন পণ্য। তবে মিনিয়েচার রেপ্লিকা, ফ্রিজ ম্যাগনেট ও বিভিন্ন ধরনের ফ্রেমই প্রতিষ্ঠানটির জনপ্রিয় পণ্য। এসব পণ্যে দেশের দর্শনীয় বিভিন্ন স্থাপনা, স্থান ও বিষয়কে ফুটিয়ে তোলা হয়।

শাফাত কাদির জানান, বর্তমানে অনলাইনের পাশাপাশি ৩৬টি ব্র্যান্ডের দোকানে তাদের পণ্য বিক্রি হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন পাঁচ তারকা হোটেল, বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন স্থানে হাতবাক্সের পণ্য বিক্রি হয়। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাংকসহ বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানে পণ্য সরবরাহ করেন তারা। তাদের ৭০ শতাংশ ক্রয়াদেশই বিভিন্ন বিক্রয়কেন্দ্র ও করপোরেট প্রতিষ্ঠান থেকে আসে। এ ছাড়া বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠান ও পুনর্মিলনীতেও পণ্য তৈরির ক্রয়াদেশ পান তাঁরা।

মাত্র চার লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু হয়েছিল হাতবাক্সের যাত্রা। এখন কোম্পানিটি বছরে প্রায় ৪ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করে। প্রতি মাসে গড়ে ১০ হাজার পিস রেপ্লিকা ও অন্যান্য পণ্য বিক্রি করে। একজন কর্মী নিয়ে শুরু করা প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে নিয়মিতভাবে অর্ধশতাধিক কর্মী কাজ করছেন। আজিমপুরের কার্যালয় ছাড়াও ঢাকার নবাবগঞ্জে পৃথক দুটি কারখানা রয়েছে হাতবাক্সের। এ ছাড়া লালবাগে রয়েছে আরেকটি শাখা কার্যালয়।

শাফাত কাদির বলেন, সারা বিশ্বেই ট্যুরিজম স্যুভেনিরের চাহিদা রয়েছে। তবে এই বাজারের প্রায় ৮০ ভাগই চীনের দখলে। ফলে বৈশ্বিক বাজারেও আমাদের ভালো করার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে হাতবাক্সের পণ্য তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে দেশের বাইরের যাচ্ছে। তবে ভবিষ্যতে নিজেরাই বিদেশে পণ্য রপ্তানি করতে চান বলে জানান শাফাত।