ঋণ পেতে যত ভোগান্তি নারীদের

একজন নারী গ্রাহকের সঙ্গে সেবা নিয়ে কথা বলছেন এক নারী কর্মকর্তা। গতকাল ঢাকার গুলশানে আইডিএলসির কার্যালয়েছবি: আশরাফুল আলম

সহজে ব্যাংকঋণ পেতে নারীদের জন্য সরকার বিভিন্ন সুবিধা চালু করেছে। ব্যাংকগুলোও আগের চেয়ে আন্তরিক হয়েছে। এরপরও কিছু সমস্যা রয়েই গেছে। এ কারণে অনেক ব্যাংক নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে চায় না। আবার যথাযথ কাগজপত্র ও যোগ্যতা না থাকলেও ব্যাংক ঋণ দেয় না।

জাতীয় শিল্পনীতি ২০১৬-তে বলা হয়েছে, এসএমই খাতে ঋণের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মোট ঋণের মাত্র ৫ শতাংশের কম পেয়েছেন নারী উদ্যোক্তারা।

কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি খাতের (সিএমএসএমই) নারী উদ্যোক্তাদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন সুবিধা। যেমন নারীদের ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন ধরনের পুনঃ অর্থায়ন স্কিম আছে। এগুলোর সুদের হার ৫ শতাংশ থেকে শুরু হয়, যেখানে সাধারণ ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ। এ ছাড়া করোনার সময়ে দেওয়া ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিলের সুদহার ৪ শতাংশ। এরপরও নারী উদ্যোক্তারা পিছিয়ে আছেন ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে।

কী বলছেন নারী উদ্যোক্তারা

নতুন ঋণগ্রহীতারা ঋণ পেতে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন। এ ছাড়া নির্দিষ্ট পরিমাণে লেনদেন, জামিনদার, বাণিজ্যিক জায়গা না থাকা ইত্যাদি কারণে নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে যায়।

কৃত্রিম হাত-পা সংযোজনের উপকরণ তৈরির প্রতিষ্ঠান ইজি লাইফ ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান বিউটি বেগম প্রথম আলোকে বলেন, একজন নতুন উদ্যোক্তার জন্য প্রথম সমস্যা হয় তাঁর ব্যবসার ধরন সম্পর্কে ব্যাংককে বোঝানো। প্রচলিত ধারার বাইরের কোনো ব্যবসা হলে ব্যাংক ঋণ দিতে একদমই আগ্রহ দেখায় না। নিজেও এই সমস্যার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন বলে জানান বিউটি বেগম।

আবার কয়েকজন উদ্যোক্তা বলেন, ব্যবসায়ের ধরন বোঝানো গেলেও সমস্যা তৈরি হয় বার্ষিক নির্দিষ্ট পরিমাণ লেনদেন নিয়ে। ব্যাংকের চাহিদা অনুসারে নির্দিষ্ট পরিমাণ লেনদেন না থাকলে তারা ঋণ দিতে চায় না। এ ছাড়া প্রায় ক্ষেত্রেই ব্যাংকগুলো ঋণের শর্ত হিসেবে বাণিজ্যিক জায়গা রয়েছে কি না, তা বিবেচনা করে।

কিন্তু একজন নতুন নারী উদ্যোক্তার পক্ষে এগুলোর সংস্থান করা সহজ নয়। পাশাপাশি একাধিকবার বিভিন্ন নথিপত্র জমা দেওয়া নিয়েও অভিযোগ আছে নারীদের।

কিস্তি পরিশোধ নিয়ে উদ্যোক্তাদের সমস্যার কথা জানিয়েছেন ক্লে ইমেজের স্বত্বাধিকারী রেহানা আক্তার। তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো ঋণ দেওয়ার পরের মাস থেকেই কিস্তির টাকা চায়। ফলে ঋণের টাকা বিনিয়োগের ন্যূনতম সময়ও পাওয়া যায় না।

জামিনদার বা গ্যারান্টার নিয়ে সমস্যার কথা জানান কেউ কেউ। তুলিকা নামক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইশরাত জাহান চৌধুরী বলেন, ব্যাংকগুলো সাধারণত অন্য কোনো ব্যবসায়ীকে জামিনদার হিসেবে দেখাতে বলে। এটা অনেক নারী উদ্যোক্তার পক্ষেই ব্যবস্থা করা কঠিন। এ কারণে অনেক নারী উদ্যোক্তা ব্যাংকঋণ নিতে আগ্রহী হন না।

নারী উদ্যোক্তা বিউটি বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষুদ্র নারী ব্যবসায়ীদের ঋণ খেলাপি হওয়ার হার নেই বললেই চলে। অন্যদিকে বড় ব্যবসায়ীদের মধ্য থেকেই বেশির ভাগ খেলাপি হন। তাহলে ছোটদের ঋণ দিতে ব্যাংকগুলোর এত সংকোচ কেন?

ব্যাংক কী বলছে

নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়ার পরিবেশ আগের চেয়ে অনেক অনুকূল হয়েছে বলে দাবি বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তাদের। তাঁরা বলছেন, উদ্যোক্তা ও ব্যাংকের মধ্যে যোগাযোগের ঘাটতির কারণে কিছু সমস্যা থেকে যায়।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যাংকগুলো নিরাপত্তার খাতিরেই সবার থেকে সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্য চায়। সুতরাং সাধারণ এসব তথ্য সংরক্ষণ করলে যে কেউ ঋণ পেতে পারেন। অধিকাংশ ব্যাংক একজন ভালো জামিনদার পেলে ঋণ অনুমোদন করে। এ ছাড়া কিস্তি প্রদানের বিষয়ে ঋণচুক্তির সময়েই আলোচনা করে নিলে পরবর্তী সময়ে সমস্যায় পড়তে হয় না।

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) বাংলাদেশের কান্ট্রি ইকোনমিস্ট নাজনীন আহমেদ বলেন, অনেক নারী উদ্যোক্তা শ্রমবাজারে যুক্ত হয়েছেন। তবে তাঁরা যে পরিমাণে ঋণ চান, সে পরিমাণে পান না। উদ্যোক্তা পাঁচ লাখ টাকা ঋণ চাইলে দেখা যায় ব্যাংক ৫০ হাজার টাকা দিতে চায়। এ ছাড়া অপ্রয়োজনীয়ভাবে একাধিক জামিনদার চায়। এ রকম বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করার সুযোগ রয়েছে।

নারী উদ্যোক্তাদের সহজে ঋণ পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন নাজনীন আহমেদ। তিনি বলেন, কোনো প্রস্তুতি ও ব্যবসায়ের ধারণা ছাড়া ঋণ প্রত্যাশা করা ঠিক না। একজন উদ্যোক্তাকে ব্যাংকের দায়বদ্ধতার বিষয়গুলোও বিবেচনা করতে হবে। নিয়মিত লেনদেনের হিসাব রাখলে ও প্রয়োজনীয় নথিপত্র থাকলে ব্যাংকের ঋণপ্রাপ্তি সহজ হবে।