ইউরোপে বিয়ের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশি ওবায়দুলের জুতা
জুতার সোল (নিচের অংশ) পাটের সুতা দিয়ে তৈরি আর ‘আপার’ মানে ওপরের অংশ তৈরি হয় কাপড় বা চামড়া দিয়ে। এই জুতার নাম এসপাড্রিলস। বলা হয়ে থাকে, গ্রীষ্ম মৌসুমে ফরাসি নারীদের পায়ে এই জুতা শোভা পায়। ইউরোপজুড়ে এই জুতার প্রচলন রয়েছে। সাধারণ ব্যবহারের পাশাপাশি বিয়ের মতো বিশেষ অনুষ্ঠানেও পরা হয় এ ধরনের জুতা। বাংলাদেশের উদ্যোক্তা ওবায়দুল হক রাসেলও এখন ইউরোপের ঐতিহ্যবাহী এসপাড্রিলস জুতা তৈরি করেন। তাঁর কোম্পানির জুতা রপ্তানি হয় ইউরোপের ১০টি দেশে।
ওবায়দুল হক জানান, ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে হিসেবে ছোটবেলা থেকে তাঁরও ব্যবসা করার ইচ্ছা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় বাবার ব্যবসায়ে সহযোগিতার পাশাপাশি নিজের ভবিষ্যৎ ব্যবসায়িক পরিকল্পনা নিয়েও ভাবতে থাকেন এই উদ্যোক্তা। বাবার ফল আমদানি ও বিপণন এবং কাঠের ব্যবসায়ের কাজে তাঁকে বিভিন্ন স্থানে যেতে হতো। এই যাতায়াতের সুবাদে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা সম্পর্কে জানার আগ্রহ বাড়ে তাঁর। এভাবেই ২০০৩ সালে একবার কুমিল্লায় গিয়ে এসপাড্রিলস জুতা সম্পর্কে জানতে পারেন ওবায়দুল। তখনই তিনি রপ্তানিমুখী এ জুতা তৈরির কথা ভাবতে শুরু করেন।
যেভাবে শুরু এসপাড্রিলসের যাত্রা
ওবায়দুল হক রাসেলের এসপাড্রিলসের যাত্রা শুরু ২০১৬ সালে। তিনজন কর্মী ও ১০ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করেন কাঙ্ক্ষিত এই ব্যবসায়িক উদ্যোগ। কোম্পানির নাম দেন এমাস ফুটওয়্যার লিমিটেড। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলায় ৪০ শতাংশ জায়গায় স্থাপন করেন কারখানা। যন্ত্রপাতি আনেন চীন থেকে। পরের বছরই প্রথম এসপাড্রিলস জুতা রপ্তানি করেন ফ্রান্সে।
এটি অবশ্য ওবায়দুলের প্রথম ব্যবসা নয়। তিনি জানান, ২০১২ সালের শেষ দিকে বিয়ের কিছুদিনের মধ্যে মাত্র তিন হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে প্রথমে পোশাক খাতের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের (গার্মেন্টস অ্যাক্সেসরিজ) ট্রেডিং ব্যবসা শুরু করেন। এতে ভালো লাভ হওয়ায় বছর তিনেক পরে ট্রেডিং ছেড়ে গার্মেন্টস অ্যাক্সেসরিজ উৎপাদনে ঝোঁকেন তিনি। ২০১৫ সালে চীনা একটি কোম্পানির সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগে গাজীপুরে স্থাপন করেন পোশাক সরঞ্জাম তৈরির কারখানা, যেটির কার্যক্রম এখনো চলমান।
বিশেষ এই জুতা তৈরির কৌশল
কীভাবে এসপাড্রিলস জুতা তৈরি হয় জানতে চাইলে ওবায়দুল হক জানান, এসপাড্রিলস জুতার দুটি অংশ থাকে। এক. জুতার আপার বা উপরিতল, যা কাপড় দিয়ে তৈরি। ডাইং করা কাপড় দিয়ে বানানো হয় জুতার আপার বা ওপরের অংশ। তবে এ জন্য অনেক সময় চামড়াও ব্যবহার করা হয়। দুই. সোল বা নিচের অংশ, যা পাটের সুতা দিয়ে তৈরি। সোল তৈরির জন্য প্রথমে পাটের সুতা দিয়ে যন্ত্রের সাহায্যে বেণি বানানো হয়। এরপর সেটিকে হাতে সোলের আকার দেওয়া হয়। এরপর আবার যন্ত্রের সাহায্যে তাপ ও চাপ দিয়ে সোল তৈরি করা হয়। এরপর দুই অংশকে সেলাই করে তৈরি হয় এসপাড্রিলস জুতা। এই সেলাইয়ের কাজটি করেন ঝিনাইদহের প্রত্যন্ত গ্রামের সাত শতাধিক নারী। সবশেষে জুতাগুলোকে কারখানায় এনে ফিনিশিং করে রপ্তানি উপযোগী করে তোলা হয়।
ওবায়দুল হক জানান, গ্রামের নারীদের জন্য সাধারণত কারখানায় এসে কাজ করার উপযোগী পরিবেশ থাকে না। তবে বাসায় বসে অবসর সময়ে তাঁরা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হতে পারেন। সেই চিন্তা থেকে ঝিনাইদহের বিভিন্ন গ্রামের সাত শতাধিক নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। তাঁরাই এসপাড্রিলস জুতা সেলাইয়ের কাজটি করেন।
তৈরি পোশাকের মতো ব্যাপক চাহিদা নেই এসপাড্রিলস জুতার। তবে এর একটি ধারাবাহিক চাহিদা রয়েছে ইউরোপসহ বেশ কয়েকটি দেশের বাজারে। এ কারণে করোনার সময়েও তাঁর রপ্তানি তেমন বাধাগ্রস্ত হয়নি।ওবায়দুল হক, উদ্যোক্তা, এসপাড্রিলস জুতা
এসপাড্রিলসের চাহিদা
পাটের তন্তু বা সুতা দিয়ে তৈরি হালকা ওজনের এই এসপাড্রিলস জুতা গরমের সময় পা ঠান্ডা রাখে আবার পানি শোষণ করে বিধায় বৃষ্টির সময়েও এটি পরা যায়। তবে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই পণ্য হিসেবেও এসপাড্রিলস অনেকের পছন্দের জুতা। ইউরোপের সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে সেলিব্রিটি ও অভিজাত শ্রেণি পর্যন্ত অনেকেই এ ধরনের জুতা পছন্দ করেন।
প্রথম চালান রপ্তানির পর কয়েক মাস নতুন কোনো কার্যাদেশ পাচ্ছিল না এমাস ফুটওয়্যার। ওবায়দুল জানান, তখন ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণে ইউরোপের বিভিন্ন মেলায় অংশ নিতে শুরু করেন তিনি। এ কাজে তাঁকে সহায়তা করে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। তাতে ইতিবাচক ফলও মেলে। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে আবার রপ্তানি আদেশ পেতে থাকেন। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।
ওবায়দুল হক বলেন, তৈরি পোশাকের মতো ব্যাপক চাহিদা নেই এসপাড্রিলস জুতার। তবে এর একটি ধারাবাহিক চাহিদা রয়েছে ইউরোপসহ বেশ কয়েকটি দেশের বাজারে। এ কারণে করোনার সময়েও তাঁর রপ্তানি তেমন বাধাগ্রস্ত হয়নি। আর শতভাগ কাঁচামাল দেশের অভ্যন্তরে পাওয়ায় উৎপাদনেও সমস্যা হয়নি।
এখন পর্যন্ত মোট আট কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন ওবায়দুল হক। প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১০ জনে। বর্তমানে জার্মানি, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, স্পেন, ইতালি, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়াসহ ১০টি দেশে এসপাড্রিলস জুতা রপ্তানি করেন তিনি। পণ্য রপ্তানি করে গত বছর প্রায় ১০ লাখ মার্কিন ডলার বা ১০ কোটি টাকার মতো আয় করে এমাস ফুটওয়্যার।
পুরস্কার, পরিকল্পনা ও ব্র্যান্ডিং
উদ্যমী কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) ফাউন্ডেশন থেকে গত বছর বর্ষসেরা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পুরস্কার পেয়েছেন ওবায়দুল হক। এই উদ্যোক্তা জানান, কারখানার পরিধি বাড়ানো গেলে এসপাড্রিলস জুতা উৎপাদন ও বিক্রি দ্বিগুণ করা সম্ভব। এ জন্য ২০২৫ সালের মধ্যে নতুন বিনিয়োগ পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। এতে আরও প্রায় দেড় সহস্রাধিক লোকের কর্মসংস্থান হবে।
তবে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পণ্যের বিষয়ে কম প্রচারণা রয়েছে বলে মনে করেন ওবায়দুল হক। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এখনো সেভাবে ব্র্যান্ডিং করা যায়নি। এ কারণে ক্রেতাদের সঙ্গেও আমাদের যোগাযোগ কম হয়। এই যেমন, এসপাড্রিলস জুতা কেউ খুঁজলে আগে ভারতের নাম লিখে ক্রেতারা গুগলে অনুসন্ধান করেন। অথচ ভারতীয় ব্যবসায়ীরাই আমাদের থেকে সোল কিনে তাতে কিছু মূল্য সংযোজন করে অনেক বেশি দামে বিক্রি করছেন। এ জন্য দেশীয় পণ্যের প্রসারে দূতাবাসগুলোকে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখার পরামর্শ দিয়েছেন এই উদ্যোক্তা।
মানবিক বিভাগ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ২০০৭ সালে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন ওবায়দুল হক। স্নাতক সম্পন্ন করে ২০১২ সালের শেষ দিকে দীর্ঘদিনের পছন্দের মানুষ শারমিন সোনিয়াকে বিয়ে করেন ওবায়দুল।