সরকারি চাকরি ছেড়ে সফল উদ্যোক্তা আবু মঞ্জুর সাঈফ

  • মাসে এক হাজার কেজি বাচা ফিলে বিক্রি।

  • বিনিয়োগের পরিমাণ ৩০ লাখ টাকা।  

  • পাঙাশ মাছের উপজাত থেকেও তৈরি হচ্ছে তেল ও পশুখাদ্য।

  • দেশ থেকে বছরে ২ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির সম্ভাবনা।

আবু মঞ্জুর সাঈফ

পাঙাশ মাছ প্রক্রিয়াজাত করে ‘বাচা ফিলে’ (মাছের কাঁটাবিহীন মাংস) তৈরি করছেন উদ্যোক্তা আবু মঞ্জুর সাঈফ। মাছের এই ফিলে তিনি দেশের বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁসহ ব্যবসায়িক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করেন। এতে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন। ছয় মাসের মধ্যেই তাঁর প্রতিষ্ঠান নুইভাফর্মের মাসিক বিক্রির পরিমাণ বেড়ে পাঁচ লাখ টাকায় উন্নীত হয়েছে।

নিজের ব্যবসা নিয়ে আবু মঞ্জুর সাঈফ প্রথম আলোকে জানান, চলতি বছরের জুন মাস থেকে তিনি বাণিজ্যিকভাবে ফিলে উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করেন। দেশে এই পণ্যের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। বর্তমানে তাঁর প্রতিষ্ঠান মাসে এক হাজার কেজির বেশি বাচা ফিলে বিক্রি করছে, যার বাজারমূল্য প্রায় পাঁচ লাখ টাকা। টঙ্গীর শিলমুন এলাকায় চার হাজার বর্গফুট জায়গায় কারখানা গড়ে তুলেছেন। কারখানায় ১৩ জন শ্রমিক বাচা ফিলে তৈরি করেন। প্রতিদিন এই কারখানায় গড়ে ৪০ কেজি করে ফিলে উৎপাদন করেন তাঁরা। বাজারে ভালো চাহিদা থাকায় ফিলের উৎপাদন বাড়ানো হবে। এ লক্ষ্যে ফ্রিজারসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বাচা ফিলে তৈরির পর মাছের উপজাতগুলো সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে ফিলের উৎপাদন খরচ কমবে। এতে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতামূলক দামে পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব হবে। সরকার ও বেসরকারি উদ্যোক্তারা যৌথভাবে কাজ করলে বাচা ফিলে তৈরি পোশাকশিল্পের মতোই বড় রপ্তানি খাতে পরিণত হতে পারে।
আবু মঞ্জুর সাঈফ, এমডি, নুইভাফর্ম।

আবু মঞ্জুর সাঈফ জানান, আইএসডি স্কুল, কোরিয়ানা রেস্টুরেন্ট, ধাবা, তারকা, রাওয়া ক্লাব ও কর্নেলস কেবিনসহ ৩০টির বেশি প্রতিষ্ঠানে নিয়মিতভাবে নুইভাফর্মের তৈরি পণ্য সরবরাহ করা হয়। আরও একটি বড় হোটেল ও একটি সুপারশপে ফিলে সরবরাহের বিষয়ে এখন আলোচনা চলছে বলে জানান তিনি।

বর্তমানে দেশে ভিয়েতনাম থেকে বাচা ফিলে আমদানি করা হয়। প্রতি কেজি ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাচা ফিলে মূলত প্যাঙ্গাসিয়াস গোত্রের ক্যাটফিশজাতীয় মাছ দিয়ে তৈরি হয়। এই মাছ মিঠাপানির, যা দেশে পাঙাশ নামে পরিচিত।

উদ্যোক্তা আবু মঞ্জুর সাঈফ জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে তিনি ১৯৯৭ সালে স্নাতক ও ১৯৯৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর অস্ট্রেলিয়ার একটি টেলিকম প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। সেখানে দেড় বছর কাজ করে তিনি দেশে ফিরে আসেন। আর দেশে ফিরে তিনি ২০১০ থেকে ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) ফাউন্ডেশনে ক্লাস্টার বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

যেভাবে শুরু

নিজের সন্তানদের মাছ ও আমিষের চাহিদা পূরণে বাচা ফিলে কিনতেন আবু মঞ্জুর সাঈফ। এরই মধ্যে ২০২৪ সালে তাঁর মাথায় ফিলে উৎপাদনের ধারণা এসে যায়।

ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করে তিনি জানতে পারেন, বাচা ফিলে তৈরি হয় পাঙাশ মাছ থেকে। ব্যস, চলতি ২০২৫ সালের প্রথম দিকে এসএমই ফাউন্ডেশনের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ফিলে তৈরির ব্যবসায় নেমে পড়েন। এই উদ্যোক্তা প্রথম আলোকে জানান, তিনি ব্যবসায়ে মোট বিনিয়োগ করেছেন ৩০ লাখ টাকা। গত এপ্রিল মাসে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি) থেকে লাইসেন্স নিয়ে নুইভাফর্মের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। এরপর জুন মাস থেকে বাণিজ্যিকভাবে বাচা ফিলে উৎপাদন শুরু করেন। এর আগে অবশ্য বাচা ফিলে তৈরির কৌশল শিখতে বছরখানেক চলে যায়।

নুইভাফর্মের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবু মঞ্জুর সাঈফ বলেন, ভিয়েতনাম ৭১টি দেশে বাচা মাছ রপ্তানি করছে। বদৌলতে এই খাতে দেশটিতে ট্রিলিয়ন তথা এক লাখ কোটি মার্কিন ডলারের বাজার গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশে বছরে কয়েক শ টন বাচা ফিলে আমদানি হয়, যা আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।  

আবু মঞ্জুর সাঈফ জানান, বাচা ফিলে তৈরির জন্য জীবিত মাছ প্রয়োজন হয়। ফিলের রং ও মান নির্ভর করে মাছের খাদ্য ও পানির স্বচ্ছতার ওপর। সে কারণে নুইভাফর্ম নির্দিষ্ট কিছু মাছচাষির কাছ থেকে পাঙাশ সংগ্রহ করে। বর্তমানে চাহিদা অনেক বেশি হলেও উৎপাদন সে তুলনায় কম। আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে যদি দেশে বড় পরিসরে উৎপাদন করা যায়, তাহলে বিদেশে বছরে এক থেকে দুই বিলিয়ন ডলারের ফিল রপ্তানি করা যাবে।

প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আবু মঞ্জুর সাঈফ বলেন, স্প্যানিশ ভাষায় ‘নুইভাস ফর্মাস’ অর্থ নতুন পথ। দেশে নতুন কিছু করার আগ্রহ থেকেই এই নাম বেছে নেওয়া হয়েছে।

উচ্ছিষ্টাংশ থেকেও মাছ ও মুরগির খাবার

জানা গেছে, বাচা ফিলে তৈরির প্রক্রিয়ায় মাছের মাত্র ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ মাংস পাওয়া যায়। বাকি ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ আগে বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেওয়া হতো। তবে নুইভাফর্ম মাছের কাঁটা, লেজ, মাথাসহ অন্যান্য অংশ প্রক্রিয়াজাত করে মাছ ও পোলট্রি ফিড উপাদান তৈরি করছে।

এই প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন হয় মাছের তেলও। পাঙাশের তেলে ওমেগা থ্রি রয়েছে, যা পোলট্রি ফিড, মানুষের পরিপূরক খাদ্য ও প্রসাধনসামগ্রী তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।

নুইভাফর্মের এমডি আবু মঞ্জুর সাঈফ বলেন, বাচা ফিলে তৈরির পর মাছের উপজাতগুলো সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে ফিলের উৎপাদন খরচ কমবে। এতে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতামূলক দামে পণ্য সরবরাহ করা সম্ভব হবে। সরকার ও বেসরকারি উদ্যোক্তারা যৌথভাবে কাজ করলে বাচা ফিলে তৈরি পোশাকশিল্পের মতোই বড় রপ্তানি খাতে পরিণত হতে পারে।