চুল রপ্তানি করে যেভাবে নিজের ভাগ্যবদল করেছেন শাহীন রেজা

মো. শাহীন রেজা
ছবি: সংগৃহীত

মানুষের মাথার ফেলে দেওয়া চুল বিক্রি করে নিজের ভাগ্য বদলেছেন ঝিনাইদহের প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে মো. শাহীন রেজা। কৈশোরে তাঁর স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন, তারপর ব্যবসা করবেন। প্রথম স্বপ্ন পূরণ না হলেও নিজের চেষ্টা ও পরিশ্রমে ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে তাঁর। ব্যবসায়ী হিসেবে রপ্তানি খাতে অবদানের জন্য পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কারও। অথচ মাত্র ৩৪৫ টাকা পুঁজি ও দুজন কর্মী নিয়ে শুরু করেছিলেন ব্যবসায়িক উদ্যোগ। এখন তাঁর প্রতিষ্ঠানে হাজারের বেশি লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে।  

মাথার ফেলে দেওয়া চুল রপ্তানির মাধ্যমে রপ্তানি বাণিজ্যে অবদানের জন্য ২০২০-২১ অর্থবছরে জাতীয় রপ্তানিতে রৌপ্য পুরস্কার পেয়েছে শাহীনের প্রতিষ্ঠান হেয়ার স্টাইল ফ্যাক্টরি। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠানটির হাতে এ পুরস্কার তুলে দেয়। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর উত্তরায় হেয়ার স্টাইলের কার্যালয়ে কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা মো. শাহীন রেজার সঙ্গে। কথায় কথায় উঠে আসে তাঁর উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প।  

শাহীন রেজা বলেন, চুল নিয়ে প্রচলিত একটি কথা রয়েছে, কেশ হলো অর্ধেক বেশ। তাই সৌন্দর্যের অংশ হিসেবে সব সময়ই চুলের চাহিদা ছিল। চুল এখন ফ্যাশনেরও অংশ। বিশ্বজুড়ে অনেক তারকা, অভিনেতা বা মডেল পরচুলা ব্যবহার করেন। এ কারণে সাধারণ ব্যক্তিদের মধ্যেও পরচুলার চাহিদা বেড়েছে। চাহিদা থাকায় স্বাভাবিকভাবে দেশে এ খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে। দেশে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এখন পরচুলা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যারা চুল সংগ্রহ করে প্রাথমিক প্রক্রিয়াজাত শেষে তা দেশি-বিদেশি ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে। শাহীন রেজার প্রতিষ্ঠানটি সেরকমই।

মো. শাহীন রেজার বাড়ি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার সাগান্না ইউনিয়নের বৈডাঙ্গা গ্রামে। বাবা কৃষিকাজ করেন, মা গৃহিণী। মাধ্যমিকে বাণিজ্য বিভাগে পড়ার সময়ই ব্যবসা নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয় তাঁর। ঝিনাইদহে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শেষে ২০০৩ সালে ঢাকায় চলে আসেন। ইচ্ছে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। পরে বড় ভাইয়ের পরামর্শে ঝিনাইদহের স্থানীয় একটি ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হন।

এদিকে ঝিনাইদহে ভর্তি হলেও ঢাকাতেই থাকতেন শাহীন। এ সময় নিজের খরচ জোগাতে টিউশনির পাশাপাশি বিভিন্ন খুচরা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন। কিন্তু খুব বেশি সুবিধা করতে পারেননি। ২০০৪ সালে ঢাকার মোহাম্মদপুরের একটি মেসে থাকতেন শাহীন। গ্রামের ছেলে হওয়ায় কয়লা দিয়ে দাঁত পরিষ্কারের অভ্যাস ছিল তাঁর। একদিন সকালে কয়লা ভেবে একটি ছোট পলিথিনে হাত দিয়ে দেখেন ব্যাগভর্তি মাথার চুল। তখন হঠাৎ তাঁর মনে হলো, চুলের তো একটা ব্যবসা রয়েছে। কয়েক দিন ইন্টারনেটে ও পরিচিতদের কাছ থেকে এ বিষয়ে জানার চেষ্টা করলেন। তারপর মাত্র ৩৪৫ টাকা ও দুজন কর্মী নিয়ে নেমে পড়েন ফেলে দেওয়া চুল সংগ্রহের ব্যবসায়।

দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলায় শাহীন রেজার কারখানায় কাজ করছেন নারীরা
ছবি: সংগৃহীত

শুরুর দিকে রাজধানীর বিভিন্ন ভাঙারির দোকানে চুলের খোঁজ করতেন শাহীন। এসব কাজ করতে গিয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার হাজারের বেশি হকারের সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। তবে সে সময় পরচুলার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম থাকায় আয় কম হতো। বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গেও ছিল না তেমন যোগাযোগ।

বিদেশি ক্রেতায় বিক্রিতে গতি

২০০৭ সালে পরিচিত এক হকারের মাধ্যমে চীনের দুজন ক্রেতার সঙ্গে শাহীনের যোগাযোগ হয়। এরপর থেকে বিভিন্ন বিদেশি ক্রেতার জন্য চুল সংগ্রহ করে দিতেন তিনি। তবে সব লেনদেনই হতো অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমে। ২০১০ সালে দেশের ইপিজেডভুক্ত (রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল) বড় একটি পরচুলা কারখানা থেকে ক্রয়াদেশ পান তিনি। তবে প্রতিষ্ঠানটি আনুষ্ঠানিক মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের শর্ত দেয়। এ কারণে একে একে ব্যবসা নিবন্ধন, ব্যাংক হিসাব খোলা, ঋণপত্র খোলাসহ বিভিন্ন কাজ করতে হয়েছে শাহীনকে।

এভাবে ভালো আয় হতে থাকলে ব্যবসা বড় করার পরিকল্পনা শুরু করেন। প্রাথমিকভাবে গুটি চুল সংগ্রহের পরে তা প্রক্রিয়াজাত করে (জটলা থেকে আলাদা ও পরিষ্কার করা) বিক্রি করলে বেশি দাম পাওয়া যায়। এ জন্য ২০১২ সালের দিকে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলায় ঘর ভাড়া নিয়ে প্রক্রিয়াজাতের কাজ শুরু করেন তিনি।

দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলায় শাহীন রেজার কারখানায় কাজ করছেন শ্রমিকেরা
ছবি: সংগৃহীত

বর্তমানে শাহীনের প্রতিষ্ঠান হেয়ার স্টাইলের কারখানায় স্থায়ী কর্মী রয়েছেন ৬৯ জন। এ ছাড়া ঢাকা ও দিনাজপুর মিলিয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন কাজ করেন দেড় হাজারের মতো কর্মী। ২০২০-২১ অর্থবছরে হেয়ার স্টাইল প্রায় ৮৩ লাখ (৮ দশমিক ২৯ মিলিয়ন) মার্কিন ডলারের চুল রপ্তানি করেছে। এ জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় রপ্তানি ট্রফি (রৌপ্য) পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ কোটি ২৪ লাখ ডলারের চুল রপ্তানি করে। তবে চলতি বছর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে রপ্তানি অনেক কমে গেছে বলে জানান শাহীন রেজা।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুসারে, বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১২ কোটি ৩০ লাখ মার্কিন ডলারের পরচুলা রপ্তানি হয়েছে। আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১০ কোটি ৫৯ লাখ ডলারের। সেই হিসাবে এক বছরে রপ্তানি বেড়েছে ১৬ শতাংশ। এই খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশ থেকে পরচুলা রপ্তানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে লেনদেন হয়। এ কারণে যাঁরা আনুষ্ঠানিক মাধ্যমে লেনদেন করেন, তাঁরা কম পরিমাণে ক্রয়াদেশ পান।

বাধা পেরিয়ে এগিয়েছেন

ব্যবসা শুরুর পর নানা ধরনের উত্থান-পতনের মুখেও পড়েছেন শাহীন রেজা। তিনি বলেন, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত রপ্তানি চাহিদা কম ছিল। এতে টান পড়ে পুঁজিতে। পাশাপাশি ঋণও করতে হয়। পরচুলার ব্যবসা খুবই জটিল। আগে জানলে হয়তো এ ব্যবসায় যুক্ত হতাম না। ব্যবসায়িক সংকটের পাশাপাশি চুলের ব্যবসা করতে গিয়ে বাহ্যিক নানা প্রতিবন্ধকতার মুখেও পড়েছেন শাহীন রেজা। তিনি বলেন, ২০০৭ সালের দিকে এ ব্যবসা সম্পর্কে মানুষ ততটা জানতেন না। তাই প্রায়ই বিভিন্ন স্থানে হকারদের আটকানো হতো। স্থানীয় লোকজনও অনেক সময় হকারদের সন্দেহ করতেন। এখন সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব প্রতিবন্ধকতা কমেছে।

চুল সংগ্রহের ক্ষেত্রে কিছু মজার তথ্যও দেন শাহীন। যেমন রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলো থেকে বেশি ও ভালো মানের চুল পান তাঁরা। শহুরে নাগরিকেরা চুলের যন্ত্র বেশি নেন বলে চুলের মানও ভালো থাকে বলে জানান শাহীন। এ ছাড়া নদী এলাকার মানুষের চুল পড়ার প্রবণতা বেশি। এ কারণে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে বেশি পরিমাণে চুল সংগ্রহ হয় তাঁদের।

দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলায় শাহীন রেজার কারখানায় কাজ করছেন শ্রমিকেরা
ছবি: সংগৃহীত

সাধারণত বাসাবাড়ি, বিউটি পারলার ও ময়লার ভাগাড় থেকে হকাররা ফেলে দেওয়া চুল সংগ্রহ করেন। তাঁদের থেকে এক বা একাধিক হাত ঘুরে সেই চুল আসে শাহীনের মতো ব্যবসায়ীদের হাতে। মানভেদে প্রতি কেজি চুলের দাম ২০০ থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত। আর প্রক্রিয়াজাতের পর এসব চুল প্রতি কেজি ১৫ থেকে ৩০০ ডলারে বিক্রি করা হয় বলে জানান শাহীন রেজা।  

বর্তমানে ছোট পরিসরে ফেলে দেওয়া মানুষের চুল থেকে পরচুলা তৈরির কাজ করছে হেয়ার স্টাইল ফ্যাক্টরি। তবে এটিকে আরও বড় করতে চান। ইতিমধ্যে আশুলিয়ায় ছয়তলা একটি ভবন নির্মাণ করেছেন তিনি। সেখানে কাজ করার জন্য চীন থেকে পরচুলা তৈরির কিছু সরঞ্জামও এনেছেন। এখন বড় পরিসরে কাজ শুরুর জন্য দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ খুঁজছেন এই উদ্যোক্তা।  

ব্যবসা পরিচালনার পাশাপাশি রুপালি ফাউন্ডেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছেন তিনি। এ ফাউন্ডেশন থেকে গ্রামের শিশুদের পরিচর্যা ও শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের সহায়তার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন উদ্যোক্তা শাহীন।