প্রতিবন্ধীদের জন্য কৃত্রিম হাত-পা বানাচ্ছেন মাসুদ

রিহ্যাব বাংলাদেশের কারখানায় প্রতিবন্ধী সহায়ক উপকরণ তৈরি করছে কর্মীরাছবি: প্রথম আলো

উদ্যোক্তা হওয়ার আগে মো. মাসুদ কামাল প্রায় দুই দশক ব্যাংক ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে (এনজিও) কাজ করেছেন। সেই সুবাদে প্রতিবন্ধীদের জন্য কৃত্রিম হাত-পা ও সহায়ক উপকরণ তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে পারেন। একপর্যায়ে চাকরি ছেড়ে নিজেই এ ব্যবসায়ে নামেন। গড়ে তোলেন রিহ্যাব বাংলাদেশ নামের একটি প্রতিষ্ঠান।

বর্তমানে কৃত্রিম হাত-পাসহ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সহায়ক বিভিন্ন উপকরণ বানাচ্ছে মাসুদ কামালের প্রতিষ্ঠান রিহ্যাব বাংলাদেশ। প্রথমে তিন লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন তিনি। দ্রুতই তা বিকশিত হতে থাকে। এখন বছরে তাঁর কয়েক কোটি টাকা আয় হচ্ছে।

ঢাকার সাভার উপজেলার গেন্ডা এলাকায় অবস্থিত রিহ্যাব বাংলাদেশের কার্যালয়ে গত বৃহস্পতিবার প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ কামালের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তিনি প্রথমেই তাঁর কারখানায় প্রতিবন্ধীদের জন্য কী ধরনের পণ্য তৈরি করা হয়, তা ঘুরে ঘুরে দেখান। এরপর শোনান তাঁর উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প।

মো. মাসুদ কামালের পৈতৃক বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে। তবে বাবার চাকরিসূত্রে বড় হয়েছেন ঢাকার সাভারে। সাভার অধর চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকা সিটি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। এরপর ১৯৯৫ সালে একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৯৭ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।

কর্মজীবনের একটা লম্বা সময় বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায় (এনজিও) কাজ করেছেন মাসুদ কামাল। সর্বশেষ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডিজঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্টের (সিডিডি) অর্থ বিভাগে ২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। সিডিডির বিভিন্ন কাজের মধ্যে একটি হলো, কৃত্রিম হাত-পা তৈরি করা। ফলে কাজটি কীভাবে করা হয়, তা কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান মাসুদ কামাল। পরে তিনি চাকরি ছেড়ে কৃত্রিম হাত-পা তৈরির প্রতিষ্ঠান খোলেন।

এই উদ্যোক্তা বলেন, ‘ওই সময়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো নির্দিষ্ট কিছু কাঠামো অনুসারে কৃত্রিম হাত-পা তৈরি করত। এতে অনেক সময় প্রতিবন্ধী ব্যক্তির চাহিদার সঙ্গে সহায়ক উপকরণের মিল হতো না। আমি এই জায়গায় গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে চেয়েছি। বর্তমানে ম্যানুয়ালি থেকে উচ্চ প্রযুক্তির বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী-সহায়ক উপকরণ তৈরি করছে আমার প্রতিষ্ঠান।’

রিহ্যাব বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাসুদ কামাল
ছবি: প্রথম আলো

যেভাবে শুরু

মাসুদ কামাল জানান, ২০১৫ সালের শুরুর দিকে তিনি চাকরি ছেড়ে রিহ্যাব বাংলাদেশ নামে কৃত্রিম হাত-পা তৈরির কোম্পানির নিবন্ধন নেন। পাশাপাশি সাভারের সিআরপি এলাকায় ছোট্ট একটি অফিস ভাড়া করেন, সঙ্গে রাখেন চারজন কর্মী। তাঁর প্রাথমিক পুঁজি ছিল তিন লাখ টাকা। তিনি বলেন, কৃত্রিম হাত-পা তৈরির বিষয়টি আর দশটি কাজের মতো নয়। এ জন্য পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন। তাই কোম্পানি খুলে প্রথমেই কাজ শেখার জন্য তিনি ভারতের রাজস্থান রাজ্যের জয়পুরে যান। সেখানে একটি কারখানায় ১৮ দিন অবস্থান করে হাতে-কলমে কাজ শিখে আসেন। পরে আরও কয়েকবার ভারতের একাধিক রাজ্য ও থাইল্যান্ডে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন তিনি।

কারখানা খোলার প্রথম বছরে প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য তিন শতাধিক কৃত্রিম হাত-পা ও সহায়ক উপকরণ বানায় রিহ্যাব বাংলাদেশ। পরের বছর চাহিদা আরও বৃদ্ধি পায়। এতে কারখানার পরিধি বাড়ানোর প্রয়োজন দেখা দেয়। ফলে ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি সাভারের গেন্ডা এলাকায় কারখানা সরিয়ে নেন। এ সময় আবার সাত লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন তিনি।

যেসব পণ্য বানানো হয়

জন্মগত ত্রুটি, দুর্ঘটনা কিংবা রোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে অর্থোসিস বা সহায়ক উপকরণ প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ব্রেস, স্পেশাল চেয়ার, হুইলচেয়ার, ওয়াকার। অন্যদিকে শরীরের অনুপস্থিত বা না থাকা অংশ প্রতিস্থাপন করে কৃত্রিম অঙ্গ (যেমন কৃত্রিম হাত-পা) বসানোকে প্রস্থেসিস বলে। মাসুদ কামাল জানান, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য অর্থোসিস ও প্রস্থেসিস—এ দুই ধরনের পণ্যই তৈরি করে রিহ্যাব বাংলাদেশ। এসব পণ্য তৈরির কাঁচামাল আনা হয় চীন ও ভারত থেকে।

বাজারে বর্তমানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য প্রায় দেড় শ ধরনের সহায়ক উপকরণ রয়েছে। এর মধ্যে রিহ্যাব বাংলাদেশ প্রায় ৬০ ধরনের পণ্য তৈরি করে। মাসুদ কামাল জানান, মানভেদে তাঁর প্রতিষ্ঠানের তৈরি অর্থোসিস পণ্যের দাম ৪ হাজার থেকে ১৬ হাজার টাকা এবং প্রস্থেসিস পণ্যের দাম ৫০ হাজার থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত।

রিহ্যাব বাংলাদেশের কারখানায় তৈরি কৃত্রিম হাত–পা ও বিভিন্ন প্রতিবন্ধী সহায়ক উপকরণ
ছবি: প্রথম আলো

মাসুদ কামাল বলেন, ‘প্রতিবন্ধীদের ব্যবহার্য পণ্য তৈরির জন্য যথাযথ মাপ নেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞ লোকদের দিয়ে কাজটি করা হয়। তবে প্রতিবন্ধীদের সহায়ক পণ্যের চাহিদা বাড়তে থাকায় ঢাকার বাইরে দেশের ১৭টি জেলায় রিহ্যাব বাংলাদেশের শাখা খোলা হয়েছে। এসব শাখা কার্যালয় থেকে প্রাথমিক মাপ নেওয়ার পর ঢাকার কারখানায় সে অনুযায়ী পণ্য তৈরি করা হয়।’

বর্তমানে মাসুদ কামালের প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে শতাধিক কর্মী কাজ করছেন। এখন পর্যন্ত তিনি প্রায় দেড় কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। আর পণ্য বিক্রি করে বছরে আয় হচ্ছে সাড়ে তিন কোটি টাকার মতো।

সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা বাড়ছে। যেমন বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে দেশে প্রতি ১ হাজার জনের মধ্যে প্রায় ২৮ জন প্রতিবন্ধী। ২০২১ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৪।

মাসুদ কামাল বলেন, ‘জন্মগত, দুর্ঘটনা ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিষয়ে সচেতনতাও বেড়েছে। আগে প্রতিবন্ধী শিশুকে অভিভাবকেরা ঘরের বাইরে আনতে চাইতেন না; এখন উল্টো চিত্র দেখা যায়। আর প্রতিবন্ধী সহায়ক উপকরণ সরবরাহ করে এ ধরনের মানুষের বিকাশে ভূমিকা পালন করছি আমরা।’

মাসুদ কামাল জানান, করোনার সময় তাঁর ব্যবসা বেশ মন্দার মধ্য দিয়ে যায়। তখন কয়েক মাস কর্মীদের বেতন দিলেও একপর্যায়ে ছাঁটাইয়ের পথে যেতে হয়। ওই সময় ৯০ লাখ টাকার মতো লোকসান হয় তাঁর। পরবর্তী সময়ে সরকারি প্রণোদনায় ব্যাংকঋণ নিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তিনি। রিহ্যাব বাংলাদেশের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন তাঁর স্ত্রী কানিজ ফাহমিদা।

দেশের সব জেলায় রিহ্যাব বাংলাদেশের কার্যক্রম বিস্তৃত করতে চান বলে জানান মাসুদ কামাল। বলেন, কৃত্রিম হাত-পা সংযোজনের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানির ওপর শুল্ক অনেক বেশি। এখানে সরকার কিছুটা সুবিধা দিলে আরও সাশ্রয়ী দামে এসব পণ্য দেওয়া সম্ভব হবে।

কেন এ ব্যবসায়ে এলেন, জানতে চাইলে মাসুদ কামাল বলেন, ‘আমি অন্য ব্যবসা করতে পারতাম। তাতে ভালোভাবে চলে যেত। কিন্তু আমার এ কাজে প্রশান্তি অনেক বেশি। আমার অফিসে একটা লোক হামাগুড়ি দিয়ে আসেন; পরে কৃত্রিম পা পরে স্বাভাবিক মানুষের মতো হেঁটে চলে যেতে দেখি, এটাই আমার বড় পাওয়া।’