নারী উদ্যোক্তারা কেন পণ্য বিক্রি করতে পারছেন না

রাজধানীতে গত শনিবার শেষ হওয়া এসএমই পণ্য মেলায় একজন নারী উদ্যোক্তার স্টলছবি: প্রথম আলো

গত ছয় বছরে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে সারা দেশে বিতরণ করা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) ঋণের মাত্র ৪ শতাংশ পেয়েছেন নারী উদ্যোক্তারা। পরিসংখ্যানটা যদিও হতাশাব্যঞ্জক কিন্তু আশার কথা হচ্ছে দেশজুড়ে বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণের উপকারভোগী বিপুলসংখ্যক নারী উদ্যোক্তার কথা আসেনি। ব্যাংকিং পরিষেবার সঙ্গে জড়িত না থাকা এই বিপুলসংখ্যক নারী প্রত্যন্ত অঞ্চলে ক্ষুদ্র পরিসরে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। তাঁরা প্রধানত স্থানীয় পর্যায়ে এনজিও থেকেই ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে থাকেন। পরিসংখ্যান বলছে, নারীরা ঋণের কিস্তি পরিশোধে অত্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক। তাঁরা সময়মতো ঋণ পরিশোধ করেন, নিজের ব্যবসাকে বড় করতে নতুন করে বড় আকারের ঋণ নিতেও সক্ষম হয়ে উঠছেন।

একজন নারী কর্মক্ষম হলে সচরাচর সংসারে এর ইতিবাচক প্রভাব দেখা যায়। নারীরা সাধারণত মিতব্যয়ী ও সঞ্চয়ী হন, তাঁরা হিসাব করে খরচ মিটিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে সংসার পরিচালনা করতে জানেন। অন্যদিকে সংসারে স্ত্রী রোজগেরে হলে পুরুষ সদস্যের ওপর খরচের চাপও কমে আসে। এত কিছুর পরও আমাদের দেশে নারীরা ক্ষুদ্র পরিসরে যেসব ব্যবসা পরিচালনা করছেন, তার মূল প্রতিবন্ধকতা প্রচার ও বিপণন। একজন নারী নিজের মতো করে উদ্ভাবনী শক্তি ব্যবহার করে একটি উৎপাদনকাজের সঙ্গে জড়িত হয়েও পণ্যটির যথাযথ প্রচার ও বিপণনের অভাবে কাজের ফল পাচ্ছেন না। প্রচুর সময়, শ্রম ও মেধা খরচ করেও শেষে উদ্যোগটিই মাঠে মারা যাচ্ছে।

করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নারী উদ্যোক্তাদের জন্যও প্রণোদনা ঋণের ব্যবস্থা করেছিল, কিন্তু সেখানেও কাঙ্ক্ষিত ফল দেখা যায়নি। আসলে পুঁজির অপ্রতুলতা নয়, সমস্যা লুকিয়ে আছে অন্য জায়গায়।

কোভিডের পর বর্তমানে চলমান অর্থনৈতিক মন্দার ঘোর দুর্দিনে নারীদের জন্য এই চ্যালেঞ্জ আরও বেড়েছে। মানুষ এখন নিত্যপণ্য ক্রয় করতে পারলেই সন্তুষ্ট থাকছে, অন্য কোনো সেবা গ্রহণ করা বা পণ্য ক্রয় করা যেন ক্রমান্বয়ে বিলাসিতার পর্যায়েই চলে যাচ্ছে।

নারীরা কাজ করতে চাইছেন, তাঁরা ঘর থেকে সাহস করে বাইরে বেরিয়ে এসেছেন। উৎপাদন, সেবা, ব্যবসা ইত্যাদি নানা উদ্যোগের সঙ্গে নিজেদের জড়িত করছেন তাঁরা। কিন্তু নানা ধরনের কাজ করলেও তাঁরা উঠে দাঁড়াতে পারছেন না। পণ্য বাজারজাতকরণের প্রতিবন্ধকতাই মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রেতা না থাকলে ব্যবসার মূল লক্ষ্যই বিনষ্ট হয়ে যায়। বর্তমান বাস্তবতায় ব্যবসায় বিক্রি এবং মুনাফা ঘরে আনার প্রক্রিয়া এতটাই জটিল, নারীদের জন্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাই এখন মুশকিল। অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তাঁরা হয়তো কিছুদিন চেষ্টা করতে থাকেন, একসময় হাল ছেড়ে পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়াই শেষ গন্তব্য হয়ে দাঁড়ায়।

এই বাস্তবতায় নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তার উপায় হিসেবে তিনটি প্রস্তাব এখানে সংক্ষেপে তুলে ধরছি:

এক. ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিবছর বিপুল অর্থ সামাজিক দায়বদ্ধতা খাতে (করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি-সিএসআর) খাতে ব্যয় করে। এই অর্থ দিয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান দরিদ্র জনসাধারণের জন্য কম্বল বিতরণ করে থাকেন। সেটি বজায় রেখেও যদি এই অর্থের কিছু অংশ নারী উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে পণ্য ক্রয়ের পেছনে ব্যয় করে দরিদ্র লোকদের পণ্যগুলো উপহার দেওয়া হয়, তাহলে এর মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তারা সরাসরি উপকারভোগী হতেন।

দুই. প্রতি ঈদে ধনীরা দরিদ্র মানুষদের জাকাতের কাপড় বিতরণ করেন। এই উদ্যোগগুলো মানুষের জন্য খুবই উপকারী। এ সময় কিছু ধনী ব্যক্তি যদি জাকাতের কাপড়গুলো নারী উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে ক্রয় করেন, তাহলে অনেক নারী উদ্যোক্তা সহজেই তাঁদের পণ্য বিক্রি করে ব্যবসা সচল রাখতে পারবেন।

তিন. সরকার প্রতি ঈদে জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে দরিদ্র লোকদের জন্য শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণ করে থাকে। এ ক্ষেত্রে কাপড় ক্রয় করার সময় যদি নারী উদ্যোক্তাদের যদি বিবেচনায় আনা হয়, তবে নারী ব্যবসায়ীরা লাভবান হতেন।

গত ২৪ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত দশম জাতীয় এসএমই পণ্য মেলা-২০২২ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয়েছে। মেলায় মোট ৩২৫টি স্টলে সারা দেশ থেকে আসা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা তাঁদের পণ্য প্রদর্শনী ও বিক্রি করছে। উদ্যোক্তাদের মধ্যে শতকরা ৬০ জনই নারী। মেলা ঘুরে এসে আমার অভিজ্ঞতা হলো, বেশির ভাগ দোকানি গালে হাত দিয়ে বসে আছেন, মেলায় বিক্রেতা আছেন, ক্রেতা নেই। অল্প কয়েকজন দর্শনার্থী কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ঘুরছেন কিন্তু জিনিসপত্র কেনায় তাঁদের কোনো তৎপরতা ছিল না।

আসলে ব্যবসা-বাণিজ্যের পুরো প্রক্রিয়াটির মধ্যে সমন্বয় ও গতিশীলতা দরকার। নইলে বহু উদ্যোগ চোখে পড়বে কিন্তু ফলাফল হিসাব করতে বসলে হতাশা ছাড়া কিছুই দৃশ্যমান হবে না।

লেখক: এসভিপি ও এসএমই প্রধান, আইআইডিএফসি