সিরাজগঞ্জের দুগ্ধজাত পণ্যের বাজার বড় হচ্ছে

খামারে গরুর যত্ন িনচ্ছেন এক খামারি
ছবি: সংগৃহীত

সিরাজগঞ্জ জেলায় গাভি পালন ও দুধ উৎপাদনের ইতিহাস প্রায় দেড় শ বছরের পুরোনো। এই জেলায় উৎপাদিত গরুর দুধ সারা দেশে চলে যায়। তবে জেলার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের তৈরি বিভিন্ন দুগ্ধজাত পণ্য দীর্ঘদিনেও বড় বাজার ধরতে পারেনি। যথাযথ উৎপাদন ও বিপণন পদ্ধতি না থাকাই এর কারণ। এখন অবশ্য সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতায় অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে বলে জানান স্থানীয় উদ্যোক্তারা। 

সম্প্রতি সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, এই জেলার কয়েকটি উপজেলায় কয়েক শ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ঘি, চিজ বা পনির, ছানা, লাবান, হোয়ে মিল্ক, মিষ্টি, দইসহ বিভিন্ন ধরনের দুগ্ধজাত পণ্য তৈরির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বর্তমানে এসব পণ্যের বার্ষিক বাজারমূল্য আনুমানিক ৫০ কোটি টাকার ওপরে উদ্যোক্তারা পণ্য উৎপাদনে ইতিমধ্যে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়েছেন। পাশাপাশি পরিবেশ সুরক্ষা ও মান উন্নত করার বিষয়েও জোর দিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁদের সহযোগিতা করছে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনসহ (পিকেএসএফ) আরও কিছু প্রতিষ্ঠান। 

২০১৯ সাল থেকে বিশ্বব্যাংক ও পিকেএসএফ দেশে টেকসই ও পরিবেশসম্মত ব্যবসা উদ্যোগ বাড়াতে ১৩ কোটি মার্কিন ডলারের ‘সাসটেইনেবল এন্টারপ্রাইজ প্রজেক্ট’ (এসইপি) হাতে নেয়। প্রকল্পটির অধীনে সারা দেশে ৬৪টি উপপ্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর ও রায়গঞ্জ উপজেলায় এসইপি দুগ্ধজাত পণ্য উপপ্রকল্প একটি। উপপ্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বেসরকারি সংস্থা ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এনডিপি)।  

পিকেএসএফ এখন শাহজাদপুর ও রায়গঞ্জ উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে ৭০০ উদ্যোক্তাকে নিয়ে কাজ করছে। দুগ্ধজাত পণ্যের পাশাপাশি বায়োগ্যাস, ট্রাইকো কম্পোস্ট সার ও সাইলেজ (গোখাদ্য) উৎপাদনে সহযোগিতা করছে সংস্থাটি। সম্প্রতি পিকেএসএফের আয়োজনে ঢাকার একদল সাংবাদিক শাহজাদপুর ও রায়গঞ্জ উপজেলা ঘুরে উদ্যোক্তাদের গল্প শোনেন। 

দুগ্ধ উৎপাদনের হিসাব

জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের হিসাবে, সিরাজগঞ্জ জেলায় ছোট-বড় প্রায় ৩৩ হাজার গরুর খামার রয়েছে। এসব খামারে গরু আছে ১৫ লাখের বেশি; যার প্রায় অর্ধেকই গাভি। এ ছাড়া দুই উপজেলায় খামারের পাশাপাশি বেশির ভাগ বাড়িতে দুধ উৎপাদনকারী একাধিক গাভি রয়েছে। 

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই জেলায় ৬ লাখ ৪০ হাজার টন দুধ উৎপাদিত হয়েছে। মিল্ক ভিটা, আড়ংসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দুগ্ধ সংগ্রহকারী ও প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান খামারিদের কাছ থেকে দৈনিক প্রায় ৩ লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করে। প্রতি লিটার দুধ গড়ে ৫৫ টাকা দরে কেনাবেচা হয়। সেই হিসাবে দৈনিক বিক্রি দাঁড়ায় ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকার ওপরে। 

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. ওমর ফারুক বলেন, সরকারি-বেসরকারি সহায়তার ফলে খামারিরা কম খরচে দুগ্ধ উৎপাদন করতে পারছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন দুগ্ধজাত পণ্যের উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। তবে গোখাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও বড় বাজার ধরা একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।

বৈচিত্র্যময় দুগ্ধজাত পণ্য 

স্থানীয় খামারিরা জানান, করোনার সময় লকডাউন ও চাহিদা কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছিলেন তাঁরা। এ ছাড়া গোখাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেড় বছর ধরে উৎপাদিত দুধ বিক্রি করে আগের মতো আয় হচ্ছে না তাঁদের। অন্যদিকে দুধ সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় অনেক সময় কম দামেও দুধ বিক্রি করতে হয়। এ ক্ষেত্রে অবশ্য স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন দুগ্ধজাত পণ্য তৈরির উদ্যোগ খামারিদের লোকসান কমাতে কিছুটা সাহায্য করছে। 

সিরাজগঞ্জে এসইপি দুগ্ধজাত পণ্য উপপ্রকল্পের ব্যবস্থাপক মো. আবদুল মালেক আকন্দ জানান, তাঁদের প্রকল্পের আওতায় ১৪ জন উদ্যোক্তা মোট ২২টি দুগ্ধজাত জাত পণ্য নিয়ে কাজ করছেন। তাঁরা প্রতি মাসে প্রায় ৩০ টন চিজ, ৩ হাজার কেজি ঘিসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি করছেন। এসব পণ্য বিক্রি করে বছরে তাঁদের আয় হয় প্রায় ১৩ কোটি টাকা। আবদুল মালেক আকন্বলেন, এই ১৪ জন ছাড়া শাহজাদপুর ও রায়গঞ্জে আরও অন্তত ১২০ জন দুগ্ধজাত পণ্যের উদ্যোক্তা রয়েছেন। তাঁরা সবাই টেকসই পণ্য উৎপাদন পদ্ধতিতে গেলে এই এলাকার দুগ্ধজাত পণ্যের বার্ষিক বাজার ১২০ কোটি টাকা ছাড়াবে। 

দুধ থেকে মাখন আলাদা করা হচ্ছে
সংগৃহীত

যেসব পরিবর্তন এসেছে

পিকেএসএফ কর্মকর্তারা জানান, দুগ্ধজাত পণ্য উপপ্রকল্পের লক্ষ্য হলো পরিবেশবান্ধব উপায়ে নিরাপদ দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের আয় বাড়ানো। এ জন্য গ্রামীণ দুগ্ধ সংগ্রহ কেন্দ্র (ভিএমসিসি) স্থাপন, গাভির জন্য পরিবেশবান্ধব বাসস্থান নির্মাণ, দূষণ রোধ, বিভিন্ন দুগ্ধজাত পণ্য তৈরিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি সরবরাহের মাধ্যমে সহযোগিতা করা হচ্ছে। এ ছাড়া পণ্যের ব্র্যান্ডিং ও উন্নত বাজারে প্রবেশের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি, পরিবেশ সনদ অর্জন, পণ্যের গুণগত মান পরীক্ষা, মোড়কজাতকরণসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। 

এসব কার্যক্রমের ফলও মিলেছে। যেমন শাহজাদপুরের বাঘাবাড়ী ঘাট এলাকার উদ্যোক্তা বাসুদেব চন্দ্র রায় ২০০২ সাল থেকে দুধ থেকে ছানা ও ঘি তৈরির ব্যবসা করছেন। আগে তাঁর বিএসটিআই সনদ ছিল না। ২০২১ সালের এপ্রিলে অরূপ ছানা কারখানা নামে এ সনদ নেন তিনি। এসইপি প্রকল্পের কর্মকর্তারা তাঁকে এ কাজে সহযোগিতা করেন। এ ছাড়া পণ্যের মান যাচাইয়ের ব্যবস্থা করা, চিমনিসহ চুলা ও পরিষ্কার পানির চৌবাচ্চা স্থাপন করা হয় এসইপির সহায়তায়। এতে পণ্যের মান, দাম ও বিক্রি বেড়েছে বলে জানান এই উদ্যোক্তা।

বাসুদেব চন্দ্র আরও বলেন, ‘আগে বিক্রির জন্য অনেক সময় ক্রেতাও ঠিকভাবে পেতাম না। আর এখন নিজ প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ডে পণ্য বিক্রি করছি। আগে ৮০০ টাকা দরে প্রতি কেজি ঘি বিক্রি করতাম, যা এখন আরও ২০০-৩০০ টাকা বেশি। এখন পণ্যের চাহিদা অনেক বেড়েছে।’

শাহজাদপুরের হালুয়াঘাটির আরেক উদ্যোক্তা মো. আতাউর রহমান চিজ অর্থাৎ পনির তৈরি করেন। দুগ্ধজাত পণ্য তৈরিতে জাতীয় পুরস্কার পাওয়া এই উদ্যোক্তা মাসে ২০-২৫ লাখ টাকার দুগ্ধজাত পণ্য তৈরি করছেন। তিনি বলেন, পরিবেশবান্ধব উৎপাদন, নিজস্ব ব্র্যান্ড তৈরি ও বিএসটিআইতে নিবন্ধনের পরে রাজধানী ঢাকাসহ দূরবর্তী জেলাগুলোতে বিক্রি বেড়েছে। 

পিকেএসএফের কর্মকর্তারা জানান, তাঁদের প্রকল্পের আওতায় উদ্যোক্তাদের মধ্যে দুধ থেকে ক্রিম পৃথক্​করণের উন্নত মানের যন্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে। এতে আগের তুলনায় দুধ নষ্ট হচ্ছে কম, মাটিতে পড়ে দুর্গন্ধও ছড়াচ্ছে না। দুধ থেকে ছানা তৈরির সময় আগে যে সবুজাভ পানি ফেলে দেওয়া হতো, সেটি থেকে এখন প্রোটিনসমৃদ্ধ হোয়ে মিল্ক তৈরি হচ্ছে। এ ছাড়া কারখানায় পানির অতিরিক্ত ব্যবহার কমেছে, পণ্যের ব্র্যান্ডিং বেড়েছে, দুগ্ধজাত পণ্যের গুণগত মান পরীক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে। এর মাধ্যমে প্রিমিয়াম বাজারে এসব পণ্য প্রবেশ করছে। 

দুধ থেকে পনির তৈরি করা হচ্ছে
সংগৃহীত

পরিবেশ সুরক্ষায় জোর 

দুগ্ধজাত পণ্যের পাশাপাশি গাভি পালন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়েও কাজ হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে গোবর সংগ্রহ, ভার্মি ও ট্রাইকো কম্পোস্ট সারের উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। দুগ্ধজাত পণ্য উপপ্রকল্পের ব্যবস্থাপক আবদুল মালেক আকন্দ বলেন, ‘আমরা সাড়ে ৭০০ খামারি নিয়ে কাজ করছি। এর মধ্যে অন্তত ৭০ শতাংশ খামারি পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়গুলো মেনে চলছেন। তাতে সার্বিকভাবে পরিবেশদূষণ কমেছে।’ 

পিকেএসএফের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল কাদের প্রথম আলোকেবলেন, ‘আমরা সার্কুলার অর্থনীতি শক্তিশালী করার কাজ করছি। তাতে নতুন পণ্য ও উদ্যোক্তা তৈরির পাশাপাশি বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করা যাচ্ছে, দূষণও কমছে।’