সফল উদ্যোক্তা
অধরা স্বপ্ন ধরা দিল মাল্টা চাষের পর
গরুর খামার করার পাশাপাশি ঠিকাদারি ও পাথরের ব্যবসা করতেন সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের সিরাজুল ইসলাম। কোনোটাতেই সফলতা না পেলেও দমে যাননি। নতুন উদ্যমে শুরু করেন মাল্টার চাষ। ব্যস, সাফল্য নিজেই এসে ধরা দেয়...
সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম। ১৯৯১ সালে অস্ট্রেলিয়া থেকে গরু এনে নিজ গ্রাম মাইজগাঁও ইউনিয়নের হাঁটুভাঙা গ্রামে গড়ে তোলেন খামার। পাশাপাশি ঠিকাদারি কাজেও জড়িত ছিলেন। পাথরের ব্যবসাও করতেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই যেন কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাচ্ছিলেন না সিরাজুল। কাঙ্ক্ষিত মুনাফা না মেলায় ২০০৫ সালে গুটিয়ে নেন গরুর খামার।
তবে সিরাজুল ইসলাম হাল ছাড়েননি। বাণিজ্যিকভাবে সাফল্য পেতে মরিয়া ছিলেন তিনি। তাই নতুন উদ্যোগ নেন। বাড়িতে প্রায় ৩০ বিঘা জমিতে গাছ লাগান। ২০১৬ সালের দিকে তাঁর দুই ছেলে বিদেশে যান। তাঁরা তখন বাড়িতে অবসর সময় কাটানোর জন্য চাপ দিতে থাকেন বাবাকে। তাই সব ব্যবসা গুটিয়ে নেন সিরাজুল। তবে মাথায় ঠিকই ব্যবসার চিন্তা নিয়েই চলতে থাকেন। বাড়িতে বসে কিছু করার কথা ভাবেন। সে অনুযায়ী ২০১৭ সালে বাড়ির চারপাশে থাকা আকাশমণি, ইউক্যালিপটাস, বেলজিয়াম জাতের গাছগুলো কেটে ফেলেন তিনি। তাঁর এমন কাণ্ড দেখে সে সময় পরিবারের অন্য সদস্যরা ক্ষুব্ধ হন। প্রতিবেশীরাও হাসাহাসি শুরু করেন। কিন্তু দমে যাননি সিরাজুল। স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে ২০১৮ সালে বাড়ির চারপাশে কিছু ফলজ গাছ লাগান। এর মধ্যে দেড় হাজার মাল্টা ফলের গাছও ছিল। মাল্টা গাছগুলোতে ২০২০ সালের দিকে ফল আসে। এতেই তিনি আশাবাদী হয়ে ওঠেন।
পরের বছরই, অর্থাৎ ২০২১ সালে মাল্টা বিক্রি করে প্রায় সাত লাখ টাকা উপার্জন করেন সিরাজুল। এরপর তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বাড়ির লোকজনও মাল্টা চাষে তাঁকে উৎসাহ দেন। প্রতিবেশীরাও তাঁর মাল্টাবাগান দেখতে আসতে শুরু করেন। এ বছর সেপ্টেম্বর মাস থেকে চলতি নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত প্রায় ১৭ হাজার কেজি মাল্টা বিক্রি করেছেন। এতে প্রতি কেজি ১০০ টাকা হিসাবে ১৭ লাখ টাকা আয় হয়েছে তাঁর। এখনো গাছে যে মাল্টা রয়েছে, তাতে আরও লাখ তিনেক টাকা বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা সিরাজুল ইসলামের। উপজেলা কৃষি কার্যালয় সিরাজুল ইসলামকে বারি মাল্টা-১ চারা প্রদানের পাশাপাশি পরামর্শ ও বিভিন্ন কার্যক্রমে সহায়তা করে।
গত শুক্রবার ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার হাঁটুভাঙায় গিয়ে জানা যায়, মাল্টা চাষে সফলতার ফলে সিরাজুল ইসলামকে তাঁর নিজ গ্রামসহ আশপাশের দুই-চার গ্রামের বাসিন্দারা ‘মাল্টা সিরাজ’ নামে চেনেন। তাই খুব সহজেই তাঁর বাড়ি পৌঁছালাম। বাড়ির চারপাশে রয়েছে মাল্টার গাছ। সঙ্গে কিছু কমলা, আম, আমড়া, বরই, লিচু, বেলগাছও রয়েছে। মাল্টার গাছগুলো ফলের ভারে নুয়ে পড়েছে। সেগুলোকে বাঁশের খুঁটি দিয়ে ঠিকা দেওয়া, যাতে গাছ মাটিতে পড়ে না যায়। সব গাছেই হলুদ ও সবুজ রঙের মাল্টা ঝুলছে। দেখলেই যেন মুখে জল এসে যায়। সিরাজুল ইসলাম মাল্টাবাগানের পাশেই গড়ে তুলেছেন একটি মুরগির খামার।
আলাপকালে সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাল্টাবাগানেই সময় কাটে তাঁর। গাছে নিয়মিত পানি দেওয়া থেকে শুরু করে ফল পেড়ে বিক্রি করতে নিয়ে যাওয়া সব কাজই তিনি তদারকি করেন। আগে যাঁরা তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করতেন এখন তাঁদের অনেকেই তাঁর কাছে পরামর্শ নিতে আসেন। তিনি বলেন, প্রতিদিন বাড়ি থেকে ২০০ থেকে ৩০০ কেজি মাল্টা বিক্রি হয়। প্রদর্শনীর জন্য কিছু মাল্টা রাখা আছে, যেগুলো বিক্রি করা হচ্ছে না।
সিরাজুল ইসলাম জানান, তাঁর মাল্টাবাগানে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনারসহ বড় সরকারি কর্মকর্তারা এসেছেন। নিজের অধরা স্বপ্নগুলো মাল্টা চাষের মাধ্যমে সফল হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সিলেটের তরুণ প্রজন্মের এ ধরনের কাজে এগিয়ে আসা উচিত। প্রবাসে পাড়ি জমানোর প্রবণতা ছেড়ে নিজেদেরই উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখা দরকার। কারণ, এভাবেই তিনি এলাকায় ‘মাল্টা সিরাজ’ নামে পরিচিতি পেয়েছেন।
সিরাজুল ইসলাম জানান, বাজারে আমদানি করা মাল্টার পরিবর্তে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত মাল্টার জনপ্রিয়তা বাড়ানোর কাজ করছেন তিনি। এ লক্ষ্যে ইতিমধ্যে তিনি দুটি স্থানে নিজের উৎপাদিত মাল্টার প্রদর্শনীও করেছেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, দেশীয় মাল্টা চাষে অনেকেই এগিয়ে আসবেন। এতে সিলেটের বিভিন্ন অব্যবহৃত টিলা ও জমিগুলো চাষের আওতায় আসবে।
সিলেট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ খয়ের উদ্দিন মোল্লা বলেন, সিলেটের টিলা এলাকাগুলোর মাটি মাল্টা, কমলা, আনারস, কাজুবাদাম, কফি ও লেবুজাতীয় ফল চাষের জন্য উপযোগী। সিরাজুল ইসলামের মাল্টা চাষ দেখে অনেকেই উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। আশা করছি, এ এলাকায় দ্রুতই মাল্টা চাষ জনপ্রিয় হবে।