ঐতিহ্যবাহী খাবারকে যিনি ফিরিয়েছেন শহুরে জীবনে
আইডিএলসি-প্রথম আলো এসএমই পুরস্কার-২০২৩-এ উৎপাদনশিল্প শ্রেণিতে সেরা উদ্যোক্তা হয়েছেন সেইফ ট্রেডিং করপোরেশনের উদ্যোক্তা মো. মোস্তফা কামাল। পণ্যের ব্র্যান্ড নাম ‘সতেজ’। বর্তমানে রাজধানীর ছয়টির বেশি সুপারশপে ও কয়েক শ মুদিদোকানে বিক্রি হচ্ছে সতেজ ব্র্যান্ডের খাদ্যপণ্য।
একসময় গ্রামীণ মেলার প্রধান অনুষঙ্গ ছিল মোয়ামুড়কি, নিমকির মতো বিভিন্ন মুখরোচক খাবার। শহরেও কমবেশি চলত। তবে সময়ের আবর্তে কমেছে এসব পণ্যের সরবরাহ। পাওয়া গেলেও অস্বাস্থ্যকর ভেবে তা অনেকে খেতে চান না। ঐতিহ্যবাহী এই মোয়ামুড়কি স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদভাবে আবার মানুষের মুখে মুখে ফেরানোর উদ্যোগ নেন মো. মোস্তফা কামাল। আধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন মুখরোচক খাবার তৈরি করছেন এই উদ্যোক্তা। মোস্তফা কামালের প্রতিষ্ঠানের নাম ‘সেফ ট্রেডিং করপোরেশন’।
তবে ‘সতেজ’ ব্র্যান্ড নামে পণ্য বাজারজাত হয়ে থাকে। নামেই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ক্রেতারা যেন কিছুটা ধারণা পান, সে জন্য এমন নামকরণ, বললেন মোস্তফা কামাল। প্রায় ১৪ বছর আগে ব্যবসা শুরু করেন মোস্তফা কামাল। ধীরে ধীরে তাঁর উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা বেড়েছে, সঙ্গে ব্যবসার পরিসরও। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের নাড়ু, নিমকি, মুরালি, মনাক্কা, মোয়াবার, চিড়া, ডাল ও বাদামভাজাসহ প্রায় ৩৫ ধরনের খাদ্যপণ্য স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে উৎপাদন করা হয় সেফ ট্রেডিংয়ের কারখানায়। পাশাপাশি এলাচি, দারুচিনিসহ বিভিন্ন ধরনের মসলাপণ্য মোড়কজাত করেও বিক্রি করেন তাঁরা। পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে যন্ত্র প্রকৌশল বিষয়ে ডিপ্লোমা করেন মোস্তফা কামাল।
পড়াশোনার পাট চুকিয়ে ২০০১ সালে প্রথমে গাজীপুরের সফিপুরে একটি পেপার ও হার্ডবোর্ড কারখানায় চাকরি নেন। এক বছর কাজ করার পর উত্তরায় একটি ঠিকাদারি কোম্পানির বিপণন বিভাগে যোগ দেন। নিজেই কিছু করবেন, এমন চিন্তাভাবনা থেকে ২০০৯ সালে চাকরি ছেড়ে দেন মোস্তফা কামাল। আলাপকালে মোস্তফা কামাল জানান, ছোটবেলা থেকেই তাঁর ঘোরাঘুরির শখ। সময় পেলেই বিভিন্ন এলাকায় যান, বিশেষ করে স্থানীয় মেলাগুলোতে ঘোরেন। মূলত এভাবেই গ্রামীণ মুখরোচক খাবারের ব্যবসার ধারণাটা তাঁর মাথায় আসে। ২০১০ সালের শুরুতে নিজেদের জমানো ৯২ হাজার টাকা ও তিনজন কর্মী নিয়ে শুরু করেন ব্যবসা। এভাবেই তাঁর উদ্যোক্তাজীবনের শুরু।
যদিও উদ্যোক্তা হিসেবে মোস্তফা কামালের যাত্রা সহজ ছিল না। ব্যবসায় প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল গ্রাহকের আস্থা অর্জন। এ ছাড়া স্বল্প পুঁজি নিয়েও বেগ পেতে হয়েছে তাঁকে। তবে সব সময় স্ত্রী শায়লা আখন্দ পরামর্শ ও সহায়তা দিয়ে তাঁর পাশে ছিলেন। বর্তমান ব্যবসায় স্ত্রীর অংশীদারত্ব রয়েছে। পুঁজি কম থাকায় শুরুতে ট্রেডিং ধরনের ব্যবসা আরম্ভ করেন মোস্তফা কামাল। তখন বিভিন্ন জেলা থেকে নিজস্ব তদারকির মাধ্যমে গ্রামীণ খাদ্যপণ্য তৈরি করাতেন। এ ছাড়া ঢাকার চকবাজার থেকে কিনে আনেন ওজন মাপার ও মোড়কজাতকরণের যন্ত্র। এরপর সেসব খাদ্যপণ্য ঢাকার বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করতেন। প্রথম দিকে নিজেই দোকানে দোকানে গিয়ে এসব পণ্য সরবরাহ করতেন।
ধীরে ধীরে চাহিদা বাড়তে থাকলে কারখানা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমে টঙ্গীতে কারখানা দেন। পরে আরও বড় পরিসরে উত্তরায় নিজস্ব কারখানা গড়ে তোলেন। মোস্তফা কামাল বলেন, প্রথম দিকে নিজের পণ্য নিয়ে ঢাকার অনেক সুপারশপে গেলেও তারা রাখতে রাজি হয়নি। কয়েক মাস পর সুপারশপ মীনা বাজার প্রথম তাঁদের পণ্য নেয়। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যে সেখান থেকে ব্যাপক গ্রাহক সাড়া মেলে। প্রথম মাসেই ৭৬ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি হয়। পরের মাসে বিক্রি বেড়ে দ্বিগুণ হয়। এরপর অন্য সুপারশপগুলোও সেফ ট্রেডিং করপোরেশনের খাদ্যপণ্য নিতে শুরু করে। পাশাপাশি আরও অনেক খুচরা দোকানেও এসব পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়।
খাদ্যপণ্য তৈরির ব্যবসায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৮৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন মোস্তফা কামাল। তিনি জানান, বর্তমানে রাজধানীর ছয়টির বেশি সুপারশপে ও কয়েক শ মুদিদোকানে বিক্রি হচ্ছে সতেজ ব্র্যান্ডের খাদ্যপণ্য। পাশাপাশি অনলাইন ও সরবরাহকারীর মাধ্যমে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায়ও পণ্য যাচ্ছে। বর্তমানে মাসে গড়ে ৩৫ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হচ্ছে। মোস্তফা কামাল মনে করেন, খাদ্যপণ্যের বিষয়ে গ্রাহকের আস্থা তৈরি হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য পণ্য উৎপাদনে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি ও আন্তর্জাতিক মান সনদ নেওয়ার উদ্যোগ নেন তিনি। পাশাপাশি কারখানার সুন্দর কর্মপরিবেশ বা কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা এবং কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
২০১৯ সালের শেষে চীনে গিয়ে নিজের চাহিদামতো কয়েক ধরনের যন্ত্র তৈরি করিয়ে আনেন কামাল। তিনি বলেন, এসব যন্ত্রের মাধ্যমে সনাতনী পদ্ধতির চেয়ে চার-পাঁচ গুণ বেশি পরিমাণে উৎপাদন সম্ভব হয়। ২০২২ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক দুটি সনদ (হ্যাচাপ ও আইএসও ২২০০০: ২০১৮) পায় সেফ ট্রেডিং করপোরেশন। মোস্তফা কামাল বলেন, ‘এসব সনদ গ্রাহক ও ভোক্তাদের কাছে আমাদের আস্থা আরও বাড়িয়েছে।’ সম্মাননা মোস্তফা কামাল ২০২২ সালে বর্ষসেরা মাইক্রো উদ্যোক্তা বিভাগে পেয়েছেন জাতীয় এসএমই পুরস্কার।