ঐতিহ্যের ব্যবসায় হাজীর বিরিয়ানির ৮৩ বছর

পুরান ঢাকার কাজী আলাউদ্দিন রোডে হাজীর বিরিয়ানির বিক্রয়কেন্দ্রে ক্রেতাদের ভিড়
ছবি: দীপু মালাকার

১৯৮৭ সালের ৮ জুলাই, বিশ্বখ্যাত সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমস–এ পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ‘হাজীর বিরিয়ানি’র ওপর একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়েছিল, দিনে ১ হাজার ৯০০ থেকে ২ হাজার মানুষ হাজীর বিরিয়ানির নিয়মিত গ্রাহক ছিলেন।

৩৫ বছর পর এসে এখনো দিনে হাজারের ওপর নিয়মিত গ্রাহক রয়েছেন হাজীর বিরিয়ানির। সময়ের সঙ্গে যে পরিবর্তনটি হয়েছে, তা হলো রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়ার পাশাপাশি পার্সেলেও বিক্রি বেড়েছে। মুখে মুখেই প্রতিষ্ঠানটির নামডাক ছড়িয়েছে বহু আগে থেকেই। এরই মধ্যে দেশজুড়ে নিত্যনতুন খাবারের বহু দোকান গড়ে উঠেছে। তা সত্ত্বেও ৮৩ বছর ধরে দাপটের সঙ্গে ব্যবসা টিকে আছে হাজীর বিরিয়ানি।

শুরুতেও হাজীর বিরিয়ানির একটি শাখা ছিল, এখনো তাই। দেশজুড়ে নামডাক বাড়লেও প্রতিষ্ঠানটির শাখা বাড়েনি। মাঝে রাজধানীতে একাধিক শাখা করা হলেও নানা কারণে সেগুলো শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখা যায়নি। ফলে হাজীর বিরিয়ানি বলতে এখনো পুরান ঢাকার নাজিরা বাজারের ৭০ কাজী আলাউদ্দিন রোডের সেই পুরোনো রেস্টুরেন্টই।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, সড়কের পাশের এই রেস্টুরেন্টের ধারণক্ষমতা সব মিলিয়ে ২০ থেকে ২২ জনের। ৫টি টেবিলে ২০ জনের বসার ব্যবস্থা রয়েছে। মাঝেমধ্যে বাড়তি কয়েকটি চেয়ার যোগ করে চাপ সামাল দেওয়া হয়। সকাল আটটা থেকে শুরু করে মধ্যরাত পর্যন্ত খোলা থাকে খাবারের এই দোকান। ক্রেতার চাপ থাকলে কখনো রাত দুইটা পর্যন্ত খোলা রাখা হয়।

দুপুরের দিকে ক্রেতার চাপ এত বেশি থাকে যে বসে খাওয়ার জায়গা পেতেই দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া থেকে শুরু করে চাকরিজীবীরা এখানে খেতে আসেন। নিয়মিত ক্রেতা ছাড়াও দূরদূরান্ত থেকেও অনেকে আসেন প্রায় শতবর্ষী এ রেস্টুরেন্টে, যে বিরিয়ানি এক নামে পরিচিত।

গত বুধবার দুপুরে এ খাবারের দোকানে বসেই কথা হয় রাইসুল ইসলাম ও হাসিব রহমানের সঙ্গে। রাজধানীর দনিয়া থেকে তাঁরা এসেছেন বিখ্যাত হাজীর বিরিয়ানি খেতে। আলাপকালে তাঁদের কাছে জানতে চাইলাম, এত দূর থেকে কেন এখানে আসা? প্রশ্ন শুনে তাঁদের ঝটপট উত্তর—‘অনেক দিন ধরে প্রতিষ্ঠানটির নাম শুনছি। সময় সুযোগের অভাবে এত দিন আসা হয়নি।

তাই দুই বন্ধু মিলে পরিকল্পনা করে এলাম। অন্য বিরিয়ানি থেকে এটার স্বাদ একটু আলাদা। কারণ কী সেটা অবশ্য বলতে পারব না।’ রাইসুল ও হাসিব রহমানের মতো হাজীর বিরিয়ানির রেসিপি ৮৩ বছর ধরেই ‘গোপন বা সিক্রেট’। আর রেসিপির গোপনীয়তা রক্ষায় প্রতিষ্ঠানটির রসুইঘরে বাইরের মানুষের প্রবেশ সংরক্ষিত।

যুগের পর যুগ মানুষের মুখে মুখে জনপ্রিয় হয়ে যাওয়া হাজীর বিরিয়ানি বলতে মূলত পোলাওয়ের চালের সঙ্গে খাসির মাংসের ছোট টুকরার মিশেল। সঙ্গে মসলাপাতি। তবে এর রন্ধনপ্রক্রিয়াটি পুরোপুরি গোপন। হাজীর বিরিয়ানির প্রতি প্লেটের বর্তমান দাম ২০০ টাকা। বিরিয়ানির পাশাপাশি পাওয়া যায় বোরহানি, যা বিরিয়ানির স্বাদকে পূর্ণতা দেয়। প্রতি লিটার বোরহানির দাম ১৮০ টাকা।

গত বুধবার সকালে কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক আশরাফ বাবুর সঙ্গে। তিনি তখন রেস্টুরেন্টে বসে সকালের নাশতা করছিলেন। আলাপকালে তিনি বলেন, কাজের ফাঁকে ফাঁকেই কথা সারতে হবে।

ততক্ষণে অবশ্য দুপুরের রান্নার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। তাই বুঝতে বাকি রইল না, কেন তাঁর এত ব্যস্ততা। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে কর্মীদের নানা নির্দেশনা দিতে থাকেন আশরাফ বাবু। আলাপকালে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘হাজীর বিরিয়ানির ৮৩ বছরের ঐতিহ্য নিঃসন্দেহে গর্বের। তবে এখন ব্যবসা করা কঠিন হয়ে গেছে। কারণ, সব পণ্যের দাম বাড়তি। এ কারণে লাভের ভাগ কমে গেছে। জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও আমরা এখনো খাবারের দাম বাড়াইনি। তারপরও বিক্রি কমে গেছে।’

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এটি মূলত পারিবারিক ব্যবসা। তৃতীয় প্রজন্মের হাত ধরে এখনো দাপটের সঙ্গে টিকে আছে প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৩৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবসাটি শুরু করেন হাজি মোহাম্মদ হোসেন। তাঁর মৃত্যুর পর ব্যবসার হাল ধরেন তাঁর একমাত্র ছেলে হাজি গোলাম হোসেন। এরপর তার তিন ছেলে হাজি শাহেদ হোসেন, হাজি শাহাদাত হোসেন ও হাজি তওহিদ হোসেন মিলে বর্তমানে ব্যবসাটি পরিচালনা করছেন।

হাজীর বিরিয়ানির বর্তমান উত্তরসূরি হাজি শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার দাদা (প্রতিষ্ঠাতা হাজি মোহাম্মদ হোসেন) যাঁদের কাছ থেকে মালামাল সংগ্রহ করতেন,আমার বাবাও তাঁদের কাছ থেকে মালামাল নিয়ে রেস্টুরেন্ট পরিচালনা করতেন। আমরাও সেই ধারা অব্যাহত রেখেছি। দাদার আমলে যে ব্যবসায়ী আমাদের এ খাবারের দোকানের জন্য চাল সরবরাহ করতেন, এখনো তাঁদের বংশধরেরাই সরবরাহ করেন। মসলা ও মাংসসহ অন্যান্য উপকরণের ক্ষেত্রেও তাই। এই আস্থার কারণে তাঁরা ভালো করেই জানেন, আমাদের ব্যবসা টিকে থাকা মানে তাঁদেরও ব্যবসা টিকে থাকা। বংশানুক্রমিক এ ঐতিহ্য ধরে রাখতে তাই আমরা উভয় পক্ষই বেশ যত্নশীল।’

প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান উত্তরাধিকারীরা জানান, ১৯৩৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে হাজীর বিরিয়ানির ব্যবসা শুরু হলেও তারও আগে থেকে রেস্টুরেন্টের ব্যবসা ছিল তাঁদের। তখন ঢাকায় মোগল খাবারের বেশ জনপ্রিয়তা ছিল। হাজীর বিরিয়ানি সেই খাবারেরই একটি পদ হিসেবে পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের কাছে জনপ্রিয়তা পায়।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বদরবারে ছড়িয়ে পড়ে প্রতিষ্ঠানটির নাম। ফুড রেঞ্জার খ্যাত আন্তর্জাতিক তথ্যচিত্র নির্মাতা ট্রেভর জেমস সম্প্রতি ঢাকায় এসে হাজীর বিরিয়ানির স্বাদ নিয়েছেন। আর করোনা সংক্রমণের আগে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলারও হাজীর বিরিয়ানির স্বাদ নেন। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ দেশবরেণ্য অনেক ব্যক্তি একবার হলেও হাজীর বিরিয়ানির স্বাদ নিয়েছেন।

প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে খাবার পার্সেল হিসেবে নিলে তা সরবরাহের ক্ষেত্রে রয়েছে বিশেষ বৈশিষ্ট্য। কাঁঠালের পাতার বিশেষ ঠোঙায় সরবরাহ করা হয় পার্সেলের খাবার। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, সম্পূর্ণ আলাদা রন্ধনপ্রণালির বাইরে তাদের খাবারের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ কাঁঠালের পাতার বিশেষ ঠোঙা ‘দাওনা’। এই ঠোঙা তেল চুষে নেয়, বিরিয়ানি থাকে ঝরঝরে, খাবারের মানেরও কোনো হেরফের হয় না। আর কাঁঠালের পাতা সংগ্রহ করা হয় ঢাকার অদূরের ইছাপুরা এলাকা থেকে। একধরনের কাঠির বুননে হাতে তৈরি হয় বিশেষ এই ঠোঙা।

প্রতিষ্ঠানটির দেওয়া তথ্যমতে, ফজরের সময় থেকে রান্না শুরু করে তারা। দিনে মোটামুটি হাজারখানেক মানুষের খাওয়ার জন্য বড় তিন ডেগ বিরিয়ানি রান্না করা হয়। তাতে গড়ে দৈনিক দুই লাখ টাকার মতো বেচাকেনা হয় প্রতিষ্ঠানটির। দোকানের কর্মচারী আর বাবুর্চি মিলে কাজ করেন ২০ জন।

মাঝে পুরান ঢাকার বেচারাম দেউড়ি, বসুন্ধরা, বারিধারা ও মতিঝিল এলাকায় শাখা খুললেও নানা জটিলতায় সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাই এখন আর ব্যবসা বাড়ানোর পরিকল্পনা নেই। বরং নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির এ সময়ে গ্রাহক সন্তুষ্টি ধরে রাখার পাশাপাশি ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখাই প্রধান লক্ষ্য প্রতিষ্ঠানটির।

আলাপকালে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক জানান, হাজীর বিরিয়ানির প্রতি মানুষের ভালোবাসা এতটাই যে, কিছুদিন আগে এক প্রবাসী ৪০ বছর আগের এক হাজার টাকা পাওনা ফেরত দিতে এসেছেন। এমন ঘটনায় আমরা বেশ অবাকই হয়েছি। পরে অবশ্য ওই প্রবাসীকে বলেছি, টাকাটা যেন তিনি কোনো মসজিদে দান করে দেন। তিনি সেটিই করেছেন।’