ডিজিটাল বিপণনে সব ধরনের সেবা দিচ্ছে অ্যানালাইজেন

অ্যানালাইজেন বাংলাদেশের কার্যালয়ে কাজ করছেন কর্মীরা
ছবি: সংগৃহীত

‘মনে করুন, আপনি একটি পণ্য বা সেবার বিপণন করবেন ডিজিটাল চ্যানেলে। কিন্তু কীভাবে কাজটি করবেন, সেই বিষয়ে কোনো ধারণা আপনার নেই। কিংবা ধরুন, আপনার কোম্পানির জন্য ওয়েবসাইট, সফটওয়্যার, অ্যাপস বা গেমস বানাতে হবে। কিন্তু আপনার কোনো ধারণা নেই। তাহলে উপায়? দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। বাজারে এখন ডিজিটাল বিপণন নিয়ে কাজ করে, এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু ২০০৮-১০ সালের দিকে বিষয়টি অত সহজ ছিল না। তখন ডিজিটাল বিপণনের ধারণা দেশে সেভাবে ছিল না। সেই অবস্থায় চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমরা প্রথম কাজটি শুরু করি’।

এভাবেই নিজেদের উঠে আসার গল্প বলছিলেন দেশের প্রথম ডিজিটাল বিপণন সংস্থা অ্যানালাইজেন বাংলাদেশের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সুমিত সাহা।

সম্প্রতি রাজধানীর গুলশানে কোম্পানির কার্যালয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা হয় সুমিত সাহার। তিনি জানান, যেকোনো কোম্পানি, ব্র্যান্ড বা পণ্যের জন্য বাজার বিশ্লেষণ, নির্দিষ্ট ভোক্তাশ্রেণি নির্ধারণ, কোন মাধ্যমে কম খরচে কার্যকর বিপণন করা যাবে ইত্যাদি নানা ধরনের বিপণনকৌশল ঠিক করার কাজ করে অ্যানালাইজেন। ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে সেবা দেওয়া ছাড়াও বিভিন্ন ওয়েবসাইট, অ্যাপ, গেম, এআর ও ভিআর প্রকল্প নিয়েও কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি।

২০০৪ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে ভর্তি হন অ্যানালাইজেনের সহপ্রতিষ্ঠাতা সুমিত। পরিবার চেয়েছিল চিকিৎসক হবেন সুমিত। কিন্তু বুয়েটে ভর্তির পরে বদলে যায় তাঁর ক্যারিয়ার বা পেশার গতিপথ। ক্লাসের পড়াশোনায় খুব বেশি মনোযোগী ছিলেন না। তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাইদের পরামর্শে ফ্রিল্যান্সিং ওয়েব ডেভেলপমেন্টের কাজ শুরু করেন। শখের বশে শুরু করা কাজটি একপর্যায়ে ভালো লেগে যায় সুমিতের।

ওই সময় সুমিতের সঙ্গে ফ্রিল্যান্সিং কাজ করতেন তাঁরই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু রিদওয়ান হাফিজ। শুরুর দিকে কাজ ছিল খুবই কম। ধীরে ধীরে কাজের চাপ বাড়তে থাকে। তখন দুই বন্ধু মিলে তাঁদের উদ্যোগকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার চিন্তা করেন। সেই চিন্তা থেকেই ২০০৮ সালের আগস্টে সফটওয়্যার কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে অ্যানালাইজেন। কিন্তু ওই সময় শুধু সফটওয়্যার তৈরি করে উপার্জন করে টিকে থাকা বেশ কঠিন ছিল বলে জানান সুমিত। তাই আয় বাড়াতে ২০১০ সালে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের কাজ শুরু করেন তাঁরা।

সুমিত সাহা, এমডি, অ্যানালাইজেন বাংলাদেশ

শুরুর গল্প শোনাতে গিয়ে সুমিত বলেন, ‘সে সময় দেশে ডিজিটাল বিপণনের ধারণা একদমই ছিল না বললেই চলে। তখন আমরা দুই বন্ধু স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে গিয়েছি। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি ডিজিটাল বিপণনের সুবিধা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা। কিন্তু অধিকাংশই তেমন কোনো আগ্রহ দেখায়নি। প্রথম একটি ওয়াইম্যাক্স ইন্টারনেট সেবাদানকারী কোম্পানির কাজ পেয়েছিলাম আমরা। এরপর একটা বিদেশি ইলেকট্রনিকস কোম্পানি কাজের সুযোগ দেয়। এর পর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি’।

কাজের পরিধি বেড়ে যাওয়ায় ২০১৫ সালে রিসালাত সিদ্দিকী নামের অপর একজন উদ্যোক্তাকে অংশীদার করেন। যিনি বর্তমানে কোম্পানির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। একই বছরে লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত হয় অ্যানালাইজেন।

অ্যানালাইজেনের সহপ্রতিষ্ঠাতা সুমিত সাহা বলেন, ‘আমরা ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রে ৩৬০ ডিগ্রি, অর্থাৎ সব ধরনের সেবা দিয়ে থাকি। আমাদের ভোক্তারা ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, লিংকডইনসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে আছে। প্রতিটি মাধ্যমের কনটেন্টের ধরন, আকার, ব্র্যান্ডিং আলাদা। আমরা গ্রাহকদের এসব সামাজিক মাধ্যমের উপযোগী বিপণনকৌশল ঠিক করে দিই। এ ছাড়া ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, অ্যাপস, গেমস ডেভেলপমেন্টসহ বিভিন্ন সফটওয়্যার সেবা দিয়ে থাকি।’ তবে বিপণনের পাশাপাশি ডেটা বিশ্লেষণের ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে অ্যানালাইজেন। ভবিষ্যতে ডেটা বিশ্লেষণ নিয়ে আরও বড় ধরনের কাজ করার ইচ্ছে তাদের।

প্রায় ১৪ বছর আগে মাত্র ৮০০ টাকা পুঁজিতে যাত্রা শুরু হয়েছিল অ্যানালাইজেনের। সেই প্রতিষ্ঠানে এখন ১৩৫ জনের বেশি কর্মী কাজ করেন। এখন পর্যন্ত দেশি-বিদেশি ১০০টির বেশি প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করেছে অ্যানালাইজেন। এর মধ্যে দেশীয় বড় ব্র্যান্ড ছাড়াও আছে ইউনিলিভারের মতো বহুজাতিক কোম্পানিও। গত ২০২০-২১ সালে কোম্পানির প্রবৃদ্ধি ছিল ১৬ শতাংশ। লেনদেনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৩ কোটি টাকা। সুমিত বলেন, ‘আমরা কখনোই অ্যানালাইজেনকে স্টার্টআপ কোম্পানি বলি না। কারণ, শুরু থেকেই মূলধারার বাণিজ্যিক কোম্পানি হিসেবেই পথ চলেছে এটি।’

কাজের স্বীকৃতিও মিলেছে অনেক। এখন পর্যন্ত দেশি-বিদেশি শতাধিক পুরস্কার পেয়েছে অ্যানালাইজেন। এর মধ্যে ব্র্যান্ডিং ও বিপণনে শ্রেষ্ঠত্ব ও নেতৃত্বের জন্য ২০১৫ সালে গোল্ডেন গ্লোব টাইগার সামিট অ্যাওয়ার্ডস, ২০১৭ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় ক্যাম্পেইন এজেন্সি অব দ্য ইয়ার পুরস্কার, ২০১৯ সালে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) থেকে তিনটি বিভাগে জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তি পুরস্কার ও বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম থেকে ডিজিটাল মার্কেটিং অ্যাওয়ার্ড অন্যতম।

করোনার কারণে দেশে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের চাহিদা ও কাজ আগের থেকে অনেক বেড়েছে বলে জানান সুমিত। তরুণ উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে সুমিত সাহা বলেন, সবাইকে ব্যবসা করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। তবে কেউ যদি ব্যবসা করতে আগ্রহী হন, তাহলে তাঁদের ধাপে ধাপে এগোতে হবে। নিজেদের দক্ষতা বাড়াতে পারলে ব্যবসায় টিকে থাকার সম্ভাবনাও বাড়তে থাকে।