শখের বসে স্কুলশিক্ষিকা থেকে উদ্যোক্তা সোহেলী

সোহেলী সাজিয়া

স্কুলশিক্ষিকা সোহেলী সাজিয়া ওরফে মিথিলা ব্যবসাটা শুরু করেছিলেন অনেকটা শখের বসে। প্রথম দিকে ফেসবুক পেজে আমদানি করা পণ্য বিক্রি করতেন। পরে নিজেই একটু কারখানা খুলে ডেনিম ব্যাগ ও রিসাইকেল পণ্য তৈরি শুরু করেন। ব্যবসা করতে গিয়ে তিনি সময়ে সময়ে যেমন ঠেকেছেন, তেমনি ঠকেছেনও। তবে হাল ছাড়েননি। তিনি এখন মাসে গড়ে এক লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেন।

সোহেলী সাজিয়া সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরায় তাঁর বিদোরা ব্যাগ অ্যান্ড হ্যান্ডিক্র্যাফটসের কার্যালয়ে বসে প্রথম আলোকে তাঁর উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প শোনান। তিনি প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী। সোহেলী সাজিয়া জানান, তিনি বড় হয়েছেন চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে। সেখান থেকেই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শেষে ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের। ২০০৮ সালে মার্কেটিং বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষে কিছুদিন একটি বেসরকারি ব্যাংকে ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করেন। ২০০৮ সালের মাঝামাঝি বিয়ে হলে তিনি ঢাকার উত্তরায় চলে আসেন এবং সেখানকার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নেন।

কারখানায় কাজ করছেন শ্রমিকেরা
সংগৃহীত

একাকিত্ব কাটাতে ব্যবসায়

সোহেলী সাজিয়ার পথচলার বাঁকবদল হয় ২০১৪ সালে। ওই বছর তাঁর বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই মারা যান। এই শোকে তিনি বিষণ্নতা (ডিপ্রেশন) ও একাকিত্বে ভুগতে শুরু করেন। স্কুলের শিক্ষকতায়ও মন বসছিল না তাঁর। এভাবে কয়েক মাস যাওয়ার পরে একজন মনোরোগ চিকিৎসক তাঁকে সার্বক্ষণিক (ফুল টাইম) কোনো কাজে যুক্ত হওয়ার পরামর্শ দেন।

তখন সোহেলীকে তাঁর স্বামী সাবির আহমেদ অনলাইনে (ফেসবুকে) পণ্য বিক্রির পরামর্শ দিয়ে বলেন, চীনের তৈরি ফেব্রিকসের ব্যাগ ও কিচেন অ্যাকসেসরিজের মতো ঘরে ব্যবহৃত বিভিন্ন পণ্যের বেশ চাহিদা রয়েছে বাংলাদেশে। সোহেলীও তাতে রাজি হয়ে যান। খুলে ফেলেন একটি ফেসবুক পেজ। নাম দেন ‘মজার কেনা’। এ জন্য স্বামীর কাছ থেকে এক লাখ টাকা ধার নেন সোহেলী। পরে অবশ্য তা ফেরতও দিয়েছেন।

সোহেলী জানান, চীন থেকে পণ্যের প্রথম চালান আসে ২০১৬ সালের মাঝামাঝি। পণ্যগুলোর মধ্যে ছিল ওভেন কাভার, ওষুধের ব্যাগ, কাঁধের ব্যাগ ইত্যাদি। প্রথমে বাসার ড্রয়িংরুমে ও কয়েক দিনের মাথায় কাছাকাছি একটা বাড়ির চিলেকোঠায় একটি রুম ভাড়া নিয়ে পণ্য রাখেন। বিপণন কৌশল হিসেবে পণ্যের ভিডিও ধারণ করে ফেসবুক পেজে দিতেন তিনি। এতে অল্পদিনেই বেশ সাড়া পাওয়া যায়। তাতে ব্যবসা বৃদ্ধি পায়। তখন বছরে পাঁচ–ছয় লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হতো। এর বেশির ভাগই ছিল বিভিন্ন ধরনের ফেব্রিক ব্যাগ। এভাবে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চলে।

ব্যাগ সেলাই করছেন একজন শ্রমিক
সংগৃহীত

বিপণন থেকে উৎপাদনে

সোহেলী সাজিয়া জানান, ২০২০ সালের শুরুতে দেশে করোনার প্রকোপ শুরু হলে চীন থেকে পণ্য আমদানিতে অসুবিধায় পড়েন তিনি। তখন নিজেই দেশে ডেনিম ব্যাগ তৈরির চিন্তা করেন। সোহেলী বলেন, ‘অনলাইনে বিদেশি পণ্য বিক্রি করে ভালো লাগছিল না আমার। মাঝেমধ্যে পণ্যের মান নিয়ে গ্রাহকের অভিযোগ পেতাম। ভেবে দেখলাম, দেশে ভালো মানের ডেনিমসহ বিভিন্ন ফেব্রিক পাওয়া যায়। ফলে এ ধরনের ব্যাগ তৈরি করা সম্ভব।’

কাছাকাছি সময়ে জাপানি একটি রপ্তানিমুখী চামড়া পণ্যের (ব্যাগ ও জুতা) কোম্পানি বাংলাদেশে কারখানা বন্ধ করে দেয়। তাতে প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা চাকরি হারান। এই তথ্য জেনে সোহেলী ওই প্রতিষ্ঠানের ছয় কর্মীকে নিয়োগ দেন। আর কারখানার জন্য টঙ্গীর পুবাইলে একটি বাড়ি ভাড়া নেন। নিজের প্রথম কন্যা বিদোরার নামের সঙ্গে মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানের নাম রাখেন বিদোরা ব্যাগ অ্যান্ড হ্যান্ডিক্র্যাফটস লিমিটেড। এ নামে তাঁর একটি ফেসবুক পেজও রয়েছে।

প্রায় তিন মাস পর নিজের কারখানায় তৈরি প্রথম ব্যাগ বাজারে আনেন এই উদ্যোক্তা। ভিনটেজ ধরনের ডেনিম দিয়ে তৈরি ব্যাগটির ভিডিও ফেসবুক পেজে দেওয়ার প্রথম দিনেই ৩৮টি অর্ডার আসে। পরে এই ব্যাগের চাহিদা আরও বাড়তে থাকে। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

বর্তমানে সোহেলীর কারখানায় ১৬ জন কর্মী কাজ করছেন; যাঁদের বেশির ভাগই নারী।
সংগৃহীত

ঠেকে শেখা, ঠকেও শেখা

সোহেলী সাজিয়া প্রথম আলোকেজানান, কারখানা পরিচালনায় তিনি যেসব কর্মীর ওপরে ভরসা করতেন, তাঁদের একটি অংশ একবার হঠাৎ চাকরি ছেড়ে দেন। এতে তিনি বেশ বেকায়দায় পড়েন, ক্ষতিগ্রস্ত হন। এরপর টঙ্গী থেকে গাজীপুর সদরের শালনা এলাকায় কারখানা স্থানান্তর করেন তিনি।

বর্তমানে সোহেলীর কারখানায় ১৬ জন কর্মী কাজ করছেন; যাঁদের বেশির ভাগই নারী। ব্যবসায়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন এই উদ্যোক্তা। প্রতি মাসে প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হচ্ছে। অনলাইনের পাশাপাশি জয়িতা ফাউন্ডেশনের বিক্রয়কেন্দ্র এবং কয়েকটি সুপারশপে পাওয়া যায় বিদোরার পণ্য।

অনানুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ কয়েকটি দেশে পৌঁছেছে বিদোরার পণ্য। সোহেলী সাজিয়া জানান, বর্তমানে সারা বিশ্বে ডেনিম ব্যাগ ও রিসাইকেল পণ্যের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে ভালো মানের পণ্য তৈরি করতে পারলে দেশে বিক্রির পাশাপাশি বিদেশেও এসব পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব। এ জন্য অবশ্য আর বিনিয়োগ ও কারখানার পরিসর বাড়ানো দরকার। সোহেলী বলেন, ‘সহজ শর্তে ঋণসহায়তা পেলে ব্যবসাকে আরও এগিয়ে নিতে পারব।’