ফুলের প্রতি ভালোবাসায় ব্যবসায়ও সফল রকিবুল

মো. রকিবুল আমিন

ফুলের প্রতি আগ্রহ তাঁর ছোটবেলা থেকেই। তাই অনেকটা শখের বশে ছাত্র অবস্থায় বাগান করা শুরু করেন মো. রকিবুল আমিন। বড় হয়ে সেই শখকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। ফুল ও গাছ বিক্রি, বাগান তৈরি এবং সাজসজ্জার ব্যবসাই এখন তাঁর পেশা। 

বর্তমানে ইনডোর প্ল্যান্ট বিক্রি, ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইন ও ল্যান্ডস্কেপের পরামর্শ সেবার কাজ করছেন উদ্যোক্তা রকিবুল আমিন। এখন পর্যন্ত ছোট-বড় শতাধিক ল্যান্ডস্কেপ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে রবিকুলের প্রতিষ্ঠান গার্ডেনিং বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে বছরে তাঁর প্রতিষ্ঠানের আয় প্রায় এক কোটি টাকা। স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলিয়ে গার্ডেনিং বাংলাদেশে আড়াই শতাধিক কর্মী নিয়মিত কাজ করছেন। 

২০২২ সালে জাতীয় বৃক্ষমেলায় অংশ নেয় রকিবুল আমিনের প্রতিষ্ঠান গার্ডেনিং বাংলাদেশ। মেলায় তাদের স্টলটি সাজানো হয় ল্যান্ডস্কেপিং নকশায়
ছবি: সংগৃহীত

শখ থেকে ব্যবসা—রকিবুলের এ যাত্রাপথ খুব একটা সহজ ছিল না। ব্যবসার পুঁজি জোগাড় করতে ঋণ করেছেন বহুবার, রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুল বিক্রি করেছেন। ব্যবসায় লোকসান দিয়েছেন; পরে আবার ঘুরেও দাঁড়িয়েছেন। রকিবুল আমিনের বাড়ি কুষ্টিয়া সদরের হাউজিং স্টেট এলাকায়। পঞ্চম শ্রেণি থেকে ফুলের বাগান করতেন রকিবুল। অনেক প্রজাতির গোলাপ ফুলের গাছ ছিল তাঁর বাগানে। সে সময় জেলার অনেকেই তাঁর বাগান দেখতে আসতেন। ২০০১ সালের কথা। উচ্চমাধ্যমিক শেষে ঢাকা কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন রকিবুল। 

পড়াশোনা শেষে উদ্যোক্তা হবেন, এটি ছিল রকিবুলের লক্ষ্য। এ জন্য স্নাতকে থাকা অবস্থাতেই স্বল্পকালীন বেশ কিছু ব্যবসার উদ্যোগ নেন। সব কটিই ছিল ফুলকেন্দ্রিক। এসব উদ্যোগের কোনোটা সফল হয়েছে, কোনোটাতে গুনতে হয় লোকসান। ঢাকা কলেজে চতুর্থ বর্ষে থাকা অবস্থায় একবার বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের এক সকালে রাজধানীর শাহবাগের পাইকারি ফুল মার্কেট থেকে ১৪ হাজার টাকার গোলাপ ফুল কেনেন রকিবুল। নিজেই বিক্রি শুরু করেন সেই গোলাপ। প্রথম এক ঘণ্টায় বেশ ভালো বিক্রি হলেও পরে মুষলধারে বৃষ্টি নামে। এতে ফুল বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়, তাতে গুনতে হয় বড় লোকসান। 

ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে গার্ডেনিং বাংলাদেশের ল্যান্ডস্কেপিং নকশা ২
ছবি: সংগৃহীত

পড়াশোনা শেষে চাকরির চেষ্টা না করে স্থায়ীভাবে ব্যবসার উদ্যোগ নেন। ২০০৮ সালে রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে একেশিয়া নামে একটি বিক্রয়কেন্দ্র ভাড়া নেন। সেখানে প্রথম তিন মাস বিভিন্ন ফুল বিক্রি করতেন। কিন্তু এতে তেমন লাভ না পাওয়ায় ইনডোর প্ল্যান্ট বিক্রি শুরু করেন। রকিবুল জানান, প্রথম দিনেই ৭৫ হাজার টাকার ইনডোর প্ল্যান্ট বিক্রি করেন তিনি। দেশে প্রথম দিকে যারা ইনডোর প্ল্যান্টের ব্যবসা শুরু করে, তাদের মধ্যে একেশিয়া অন্যতম।

রকিবুল জানান, ‘ফুল ও গাছ মানুষের শখের বিষয়। সুতরাং এখানে যত বেশি বৈচিত্র্য থাকবে, তত বেশি ক্রেতা। এ জন্য পর্যায়ক্রমে ব্যবসায় বৈচিত্র্য আনার কাজ শুরু করি। ফুলের সাজসজ্জা নিয়ে ধারণা পেতে বিভিন্ন বই পড়া শুরু করি। পরে নিজেই সেভাবে নকশা তৈরি করতাম।’ 

এসব কাজের পাশাপাশি ছোটখাটো ইভেন্ট বা অনুষ্ঠানে ফ্লাওয়ার ডেকোরেশন ও মিনিয়েচার ল্যান্ডস্কেপিংয়ের (ছোট ট্রে বা স্থানে বিভিন্ন গাছ সাজিয়ে রাখা) কাজ শুরু করেন। রকিবুল বলেন, ভালো কম্পোজিশন দিতে পারলে ১০ টাকার চারাগাছ ১৫০ টাকাতেও বিক্রি সম্ভব। তাই বিভিন্ন পরিত্যক্ত জিনিস (যেমন কাঠ, ধাতব পাত্র, পাট, পাথর) ও মৃৎপাত্রের সাহায্যে ফুল ও গাছের শৈল্পিক উপস্থাপন শুরু করি। এভাবে একপর্যায়ে ল্যান্ডস্কেপ তাঁর প্রধান ব্যবসা হয়ে ওঠে। তাতে বিভিন্ন দিবস ও অনুষ্ঠানে এবং করপোরেট পর্যায়ে বিক্রি অনেক বেড়ে যায়। তত দিনে ৮-১০ জন কর্মী তাঁর প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হন। কাজের কলেবরও বাড়তে থাকে। 

ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে গার্ডেনিং বাংলাদেশের ল্যান্ডস্কেপিং নকশা
ছবি: সংগৃহীত

২০১৫ সালের শেষ দিকে বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের বিক্রয়কেন্দ্রটি হঠাৎ ছেড়ে দিতে হয়। তখন ফুল ও ইনডোর প্ল্যান্ট বিক্রি কমিয়ে পুরোদমে ল্যান্ডস্কেপ ব্যবসা শুরু করেন তিনি। রকিবুল জানান, ২০১৬-১৭ সালে তাঁকে চরম আর্থিক সংকটের মুখে পড়তে হয়। এ সময় অনেক টাকা ঋণও করেন। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। 

রকিবুলের ভাগ্য ফিরতে শুরু করে ২০১৭ সালের মাঝামাঝি থেকে। এ সময় বড় কয়েকটি কাজ পান তিনি। এর মধ্যে অন্যতম ছিল বাংলাদেশ আর্মি স্টেডিয়ামের সাজসজ্জার নকশা করা। প্রায় ৫০ লাখ টাকার সেই প্রকল্পের আয়ে সব ঋণ পরিশোধ করে দেন। ২০১৯ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম একেশিয়া থেকে বদলে করা হয় গার্ডেনিং বাংলাদেশ। ২০২০ সালে রাজধানীর আদাবরে বড় অফিস চালু করেন। 

বর্তমানে গ্রাহকের চাহিদা অনুসারে ল্যান্ডস্কেপ প্ল্যানিং, পরামর্শ সেবা ও বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ করছে গার্ডেনিং বাংলাদেশ। বিভিন্ন রিসোর্ট, করপোরেট প্রতিষ্ঠান, লেক, সড়কদ্বীপ, পোশাক কারখানা, আবাসন কোম্পানি, ইকোপার্ক, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগত বাড়ির অভ্যন্তর ও ছাদে ল্যান্ডস্কেপ কিংবা প্ল্যান্ট সজ্জার কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। 

এখন পর্যন্ত ব্যবসায় পাঁচ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছেন রকিবুল আমিন। বর্তমানে তাঁর প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা ২৬। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রকল্পে অস্থায়ী ভিত্তিতে দুই শতাধিক মানুষ কাজ করেন। ছোট-বড় মিলিয়ে শতাধিক ল্যান্ডস্কেপ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে রকিবুলের প্রতিষ্ঠান। এতে প্রতি মাসে তাঁর প্রতিষ্ঠান ৭ লাখ টাকা ও বছরে ৮৪ লাখ টাকার বেশি আয় করে। 

সাভারের একটি রিসোর্টে গার্ডেনিং বাংলাদেশের ল্যান্ডস্কেপিং নকশা
ছবি: সংগৃহীত

উদ্যোক্তা রকিবুল আমিন বলেন, দেশে গার্ডেনিং ও ল্যান্ডস্কেপিংয়ে দক্ষ জনবলের ঘাটতি রয়েছে। ব্যবসাটাও অনেকটা সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে। বর্তমানে এ বাজারের বার্ষিক আকার আনুমানিক ১০০ কোটি টাকার। অল্প কিছু প্রতিষ্ঠান এ খাতে কাজ করছে। স্থাপত্যশৈলী নিয়ে কাজ করে, এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা একেবারেই কম। ভালো কাজ করতে পারলে এ খাতের হাজার কোটি টাকার বাজার ধরা সম্ভব।

আগামী পাঁচ বছরে এ খাতে মার্কেট লিডার হতে চান রকিবুল আমিন। তিনি জানান, পেশাদার কর্মী তৈরি, নার্সারিশিল্পকে আরও আধুনিকায়ন করা, নার্সারিশিল্পের বাণিজ্য সম্ভাবনা বাড়াতে কাজ করবেন তিনি।