আনন্দের ১১০ বছরের আনন্দ

ঢাকা ও এর আশপাশের হাটগুলোতে কেক–রুটি–বিস্কুট বিক্রির মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয় ঐতিহ্যবাহী কনফেকশনারি বা বেকারি প্রতিষ্ঠান আনন্দের। ১০০ বছরের বেশি পুরোনো এই প্রতিষ্ঠানের বড় বৈশিষ্ট্য হলো এখনো বেকারি পণ্য তৈরিতে মেশিন বা যন্ত্রের চেয়ে হাতের ব্যবহারই বেশি।

ছবি : প্রথম আলো

ধরুন, ঘরে বা অফিসে আছেন অথবা কোথাও বেড়াতে গেছেন। সামনে চা কিংবা কফি এল। সেই সঙ্গে পরিবেশন করা হলো নরম তুলতুলে একটি ওভালটিন কেক, রুটি বা বিস্কুট। মুখে দেওয়ার আগেই যদি নাকে মিষ্টি গন্ধ লাগে, তাতে নিশ্চয়ই আনন্দ পাবেন। কেক–রুটি–বিস্কুট খাওয়ার এই আনন্দটাই মিলবে যদি তা আনা হয় পুরান ঢাকার আবুল হাসনাত রোডের ঐতিহ্যবাহী আনন্দ কনফেকশনারি থেকে।

আনন্দ কনফেকশনারির বয়স ১১০ বছর। সুদীর্ঘকালের এই পথচলায় প্রতিষ্ঠানটির ঢাকায় আরও তিনটি শাখা রয়েছে। আনন্দ বেকারির বর্তমান উত্তরাধিকারীদের একজন সিদ্দিকুর রহমান। তিনি আবুল হাসনাত রোডের দোকানে বসে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ জায়গাটিই আনন্দের শিকড়। এখান থেকেই শুরু হয়েছিল আমাদের যাত্রা।’

চান মিয়া, প্রতিষ্ঠাতা, আনন্দ বেকারি

সিদ্দিকুর রহমান আনন্দ কনফেকশনারির তৃতীয় প্রজন্ম। তাঁর দাদা শেখ চান মিয়া ১৯ শতকে ঢাকায় এসেছিলেন ফরিদপুরের বোয়ালমারী থেকে। দেশে তখন ব্রিটিশ শাসন চলছিল। সে সময় ঢাকার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ছিল নর্থব্রুক হল, সাধারণের ভাষায় লালকুঠি। সেখানে মঞ্চনাটক হতো, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। সেগুলো ঘিরে শিল্পী–সাহিত্যিকেরা আসতেন, আড্ডা জমত, খাওয়াদাওয়া হতো। সব মিলিয়ে জমজমাট এলাকা। লালকুঠির পাশে এক খাস ইংরেজের বেকারির দোকান, সেখানে কাজ নেন ফরিদপুরের চান মিয়া।

অখণ্ড বাংলার রাজনীতিতে তখন পালাবদলের সময়। বঙ্গভঙ্গ হয়েছে। ফলে ঢাকার গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে। কয়েক বছরের মধ্যে আবার বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। এরই মধ্যে এখান থেকে ব্যবসা গুটিয়ে বিদায় নেন ব্রিটিশ বেকারির মালিক। তত দিনে অবশ্য চান মিয়া কাজে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছেন, হাতে অর্থকড়িও জমেছে কিছু। সেই টাকা দিয়ে আবুল হাসনাত রোডে সংগীতশিল্পী লায়লা আঞ্জুমান বানুর বাবার বাগানবাড়ি কিনে সংসার পেতেছেন।

যেহেতু জীবনভর বেকারির কাজই শিখেছেন। এখানেই থিতু হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন চান মিয়া। বাড়ির একপাশেই একটা বেকারি গড়ে তোলেন। সময়টা ১৯১১ সাল। শুধু বেকারি দিয়ে বসলেই তো হলো না, ক্রেতাও থাকা চাই। রুটি–বিস্কুট খাওয়া অভিজাত লোকেরা চলে গেছেন পূর্ব বাংলা ছেড়ে। তাই টিকে থাকার জন্য চান মিয়াকে নামতে হয় অন্য এক যুদ্ধে। সারা রাত ধরে তিনি রুটি ও বিস্কুট বানিয়ে সকালে সেগুলো নিয়ে চলে যেতেন বিভিন্ন হাটে। সাধারণ মানুষই ছিল তাঁর কেক ও বিস্কুটের ক্রেতা। শুক্র ও শনিবার জিনজিরায় যান তো রোববার ছোটেন টঙ্গী হাটে। এভাবে সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতেও তিনি কোনো না কোনো হাটে রুটি–বিস্কুট বিক্রি করতেন।

ঢাকায় তখন বেকারি ছিল হাতে গোনা কয়েকটি। মানুষেরও তখন পর্যন্ত বেকারির তৈরি খাদ্যপণ্য খাওয়ার তেমন অভ্যাস হয়নি। চান মিয়ার নিরন্তর চেষ্টায় ধীরে ধীরে ঢাকার বাসিন্দাদের মধ্যে বেকারি পণ্য জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে একটি স্থায়ী দোকান খোলেন চান মিয়া। এটির নাম দেন আনন্দ কনফেকশনারি।

আনন্দ নামটি দেওয়ার পেছনেও আছে এক গল্প। চান মিয়া পদ্মাপারের মানুষ। তাই সংগত কারণেই সুরের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল। নাতি সিদ্দিকুরের ভাষায়, ‘আমার দাদা একই সঙ্গে খুব ধার্মিক ও সংগীতপ্রেমী ছিলেন। সব সময় গুন গুন করে গজল, হামদ, নাত গাইতেন। বেকারির কাজটাও যেন তাঁর কাছে ইবাদতের মতো ছিল। খুব চেষ্টা করতেন সুন্দর কাজ করার। আনন্দময় জীবনের এসব দর্শন থেকেই কনফেকশনারির নাম রাখেন আনন্দ।’

’৬৯ সালের গণ–অভ্যুত্থানের উত্তাল সময়ে মারা যান চান মিয়া। তাঁর ছেলে তারা মিয়া এ ধাক্কা সামলাতে সামলাতেই চলে আসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাদের তাণ্ডবে শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় তাঁর পরিবার। যুদ্ধ চলাকালেই ফিরে এসে বেকারি চালুর সিদ্ধান্ত নেন তারা মিয়া (সিদ্দিকুরের বাবা)। দ্বিতীয় প্রজন্ম হিসেবে তিনি যখন ব্যবসার হাল ধরলেন, তখনো উত্তাল ছিল দেশের রাজনৈতিক অবস্থা। তবে এর মধ্যেও আনন্দ যে খুব খারাপ চলছিল এমন নয়। সিদ্দিকুর বলেন, ‘আমাদের দোকানে বিখ্যাত মানুষেরা আসতেন। আমাদের পণ্যও যেত রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। আমরা তখন ছোট। পত্রিকায় যাঁদের ছবি আসত, টিভিতে যাঁদের দেখা যেত, তাঁরা আমাদের দোকানে আসতেন, ভাবতেই খুব ভালো লাগত।’

সিদ্দিকুরদের এই ভালো লাগা খুব বেশি দিন স্থায়ী হয় না। কারণ, ১৯৭১ সালে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হতে থাকে। শুরুতে পাকিস্তানি সেনাদের তাণ্ডবে শহর ছেড়ে পালিয়ে যান সিদ্দিকুরের বাবা তারা মিয়া। দেশের বিভিন্ন এলাকায় পালিয়ে থেকে অবশেষে সিদ্ধান্ত নেন, ফিরে আসবেন ঢাকায়, যুদ্ধের মধ্যেই চালু রাখবেন বেকারি। যুদ্ধের মধ্যে ফিরে এসে তারা মিয়া নিজের বাড়িতে সীমিতভাবে শুরু করেন বেকারির কার্যক্রম। সে সময়ের কথা স্মরণ করে সিদ্দিকুর বলেন, ‘তখনই আমাদের কাজে হাতে খড়ি। আমরা, মা, দাদি—সবাই মিলে বেকারির কাজ করতাম। বাবা বিক্রি করতেন। এভাবে যুদ্ধের মধ্যেও কাজ চালিয়ে গিয়েছিলাম আমরা।’

যুদ্ধ শেষে অর্থাৎ সদ্য স্বাধীন দেশের সঙ্গে আনন্দ বেকারিও নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে। তারা মিয়া তাঁর ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে ব্যবসার হাল ধরেন। আবুল হাসনাত রোডের পর ১৯৮৭ সালে চকবাজারে খোলেন দ্বিতীয় শাখা। এরপর ’৯০–তে পুরান ঢাকা থেকে বের হয়ে নতুন ঢাকার (মহাখালী) শাহীন কমপ্লেক্সে আরেকটি। সর্বশেষ ২০১২ সালে পুরান ঢাকার ওয়ারীতে চালু করা হয় চতুর্থ শাখাটি। সব মিলিয়ে চারটি শাখা নিয়েই চলছে আনন্দ কনফেকশনারির কার্যক্রম। এ কার্যক্রম শুধু রাজধানীকেন্দ্রিক।

ঢাকার এত পুরোনো প্রতিষ্ঠান হয়েও দেশজুড়ে ব্যবসা বিস্তারের চেষ্টা করেনি আনন্দ। বিশেষ করে যখন শহরের সব এলাকায় শাখা খুলে ব্যবসা বিস্তারের যুগ চলছে, আনন্দের কর্মীর সংখ্যা এখনো মাত্র ৪৫ জন। সিদ্দিকুর বলেন, ‘অনেক মানুষের জন্য কেক–বিস্কুট বানাতে হলে আমাদের স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে পণ্য বানানো শুরু করতে হবে। এটা আমরা চাই না। হাতে বানানো খাবারের একটা আলাদা স্বাদ আছে। খাবারটা হাতে বানাতে মনের মধ্যে একটা আনন্দ হয়, সেটাকেই বাঁচিয়ে রাখছি আমরা। যদি কারও আমাদের খাবার খাওয়ার ইচ্ছে হয়, তিনি আমাদের কাছে আসবেনই।’

আনন্দের খাবার পেতে ক্রেতাদের আনন্দের কাছে আসার আহ্বান জানানোর আত্মবিশ্বাস অবশ্য সিদ্দিকুরের এমনি এমনি আসেনি। এখনো রাষ্ট্রীয় অনেক অনুষ্ঠানে খাবার যায় আনন্দ থেকে। এমনকি তাঁরাও দাওয়াত পান অনুষ্ঠানের অতিথি হিসেবে। এভাবেই প্রতিষ্ঠানটি সীমিত পরিসরে কাটিয়ে দিয়েছে ১১০ বছর।

সামনে কী হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে সিদ্দিকুর হেসে বলেন, ‘সামনে কী হবে, সেটা সামনেই দেখা যাবে। এখন যা আছে, তাতেই আমরা খুব খুশি। আমাদের অনেক বাড়ি–গাড়ির দরকার নেই। আমার দাদা বলতেন, কাজটা একটা ইবাদত। এই দর্শনটাই আমরা পরবর্তী প্রজন্মকে শিখিয়ে যেতে চাই।’