উদ্যোক্তা আনোয়ারা কষ্ট লাঘবে চাকরি খুঁজছেন

আনোয়ারা আক্তার

এক রুমের ছোট একটি পারলারের মালিক আনোয়ারা আক্তার। করোনার সংক্রমণ শুরুর আগে পারলারের ভাড়া মেটানোর পরও ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা হাতে থাকত। বউ সাজানো থেকে শুরু করে পারলারের সব কাজ নিজেই করতেন। ঈদের আগে কাজের চাপ বেড়ে গেলে একজন কর্মী রাখতেন। তবে করোনা শুরুর পর পারলারটি আস্তে আস্তে বন্ধ হতে থাকে। এখন একেবারেই বন্ধ। আর তাতেই আনোয়ারার আয়ের একমাত্র পথটিও রুদ্ধ হয়ে গেছে।

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ৬০ ফুটের কাছে আনোয়ারার বাসাতেই এ পারলার। বর্তমানে পারলারটি খোলা থাকলেও কেউ আর সাজতে আসেন না। আনোয়ারার পরিচিত নারীদের কেউ কেউ আনোয়ারার বাসায় আসেন বা নিজেদের বাসায় তাঁকে ডেকে নিয়ে যান চুল কাটা বা অন্য ছোটখাটো কাজের জন্য। তাও হয়তো সপ্তাহে দু-একটি কাজের জন্য ডাক পান। নবম শ্রেণিপড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে আনোয়ারার দিন পার হয় পরের দিনটি নিয়ে দুর্ভাবনায়। অনেক দিন নিজের কষ্টের কথা কাউকে বলেননি। বাধ্য হয়েই এখন ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের কাছে নিজের কষ্টের কথা জানিয়েছেন। তাতে কেউ কেউ সহায়তাও করেছেন। কিন্তু করোনায় সবারই অবস্থা কমবেশি খারাপ।

তিন বছর ধরে মেকওভার বিউটি পারলার নামে নিজের পারলারটি চালিয়ে আসছিলেন আনোয়ারা। ভাশুরসহ বিভিন্নজনের কাছ থেকে ধারদেনা করে পারলারটি দাঁড় করিয়েছিলেন তিনি। চার বছর আগে হুট করে ঘুমের মধ্যেই মারা যান আনোয়ারার স্বামী। তারপর মেয়েকে নিয়ে অনেকটাই অসহায় হয়ে পড়েন তিনি। স্বামী মারা যাওয়ার পর ভাশুরেরা মেয়ের স্কুলের বেতনসহ হাতখরচ দিতেন। করোনায় তাঁদেরও অবস্থা খারাপ। কিন্তু আনোয়ারার দিন তো চলে না। এদিকে হাতও পাততে পারছেন না কারও কাছে।

সম্প্রতি প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে আনোয়ারা বলেন, গত চার মাস পারলারের ভাড়া দিতে পারেননি। মেয়ের স্কুলের বেতন দিতে হয় ১ হাজার ৬০০ টাকা, তা–ও দুই মাসের বাকি। মেয়ে অনলাইনে ক্লাস করে, সে বাবদও খরচ আছে। অনলাইনে পরীক্ষার সময় পাশের বাসার ওয়াইফাইয়ের সংযোগ ব্যবহার করে কাজ চালানো হচ্ছে। মেয়ে কোচিং করত, করোনার পর অর্থকষ্টে তা-ও বন্ধ করে দিতে হয়েছে।

আর্থিক অবস্থা খারাপ বলেই আনোয়ারাকে এসএসসি পাস করার আগেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর মা-বাবা। শ্বশুর-শাশুড়ি মারা গেছেন। ভাশুরদের আলাদা সংসার। সবাই খোঁজখবর নিচ্ছেন, কিন্তু তাতে তো আর আনোয়ারার দুশ্চিন্তা দূর হচ্ছে না। লালমনিরহাটের মেয়ে আনোয়ারা বলেন, ‘মা-বাবার নিজেদেরই চলে না, আমাকে কীভাবে সহায়তা করবে?’

আনোয়ারা বলেন, ‘আমরা মা-মেয়ে সকালে একটি বিস্কুট আর চা, দুপুরে ভাত আর রাতে কোনো দিন রুটি বা ভাত খেয়ে দিন পার করছি। খাবারেই যেখানে অনেক কাটছাঁট করতে হয়েছে, সেখানে কিশোরী মেয়ের বিভিন্ন চাহিদা মেটানোর তো কোনো প্রশ্নই আসে না। একেকটি দিন যে কীভাবে মেয়েকে নিয়ে পার করছি, তা শুধু আমিই জানি।’

‘সামনে কীভাবে চলব? হাতে কোনো টাকা নেই। ধারদেনায় জর্জরিত। যাঁরা সহায়তা করতেন, তাঁরাও বিপদে আছেন।’ এত সব চিন্তায় বিষণ্নতা ভর করেছে আনোয়ারার মনে। বললেন, ‘পরিচিত যাঁরাই আমাকে দেখেন, তাঁরাই চমকে যান আমার চেহারা দেখে। করোনা কবে যাবে, তার কোনো ঠিক নেই। স্বামী বেঁচে থাকতে যা বেতন পেতেন, তা দিয়ে তিনজনের মোটামুটি দিন পার হয়ে যেত। কিন্তু এখন সব পথই বন্ধ। আর এই সমাজে একা মায়েদের নানান সমস্যা তো আছেই।’

আনোয়ারা বেশ দৃঢ়ভাবেই বললেন, ‘আমি পারলারের সব কাজই বেশ ভালোভাবে করতে পারি। কোথাও যদি কাজের সুযোগ থাকে, আমি কাজ করতে চাই।’