করোনাকালেও লাভের মুখ

করোনার ধাক্কা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে নারী উদ্যোক্তা কোহিনুর ইয়াসমিনের ‘তরঙ্গ’। সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুর মাজার রোডে কারখানায় কর্মীদের কাজ তদারকি করছেন তিনি।
ছবি: প্রথম আলো

আপা, কাজ কেমন চলছে?

হেসে জবাব দিলেন, ‘আপনাদের দোয়ায় ভালো চলছে। শিপমেন্ট শুরু করেছি।’

বেশির ভাগই নাকি প্রচণ্ড লোকসানে আছেন? অনেকের ব্যবসাও বন্ধ হয়ে গেছে?

‘এটা খুবই সত্যি। তবে ভাগ্যক্রমে আমি এই সময়ে অনেক অর্ডার পেয়েছি। কর্মীদের মুখেওহাসি ফুটেছে।’

কথা হচ্ছিল নারী উদ্যোক্তা কোহিনুর ইয়াসমিনের সঙ্গে। তাঁর প্রতিষ্ঠান তরঙ্গ পাট, কচুরিপানা, হোগলাপাতা, শণ আর সিমেন্টের বস্তা থেকে ব্যাগ, ঝুড়িসহ বিভিন্ন শৌখিন পণ্য তৈরি করে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের এক সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, করোনাকালে ৬৭ শতাংশ নারী উদ্যোক্তার আয় কমেছে। তবে এই হাহাকারের মধ্যেও কেউ কেউ আলোর দিশা পেয়েছেন। সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় আলোর রেখা লক্ষ্য করে নিজেরা এগোচ্ছেন। অন্যদের অনুপ্রাণিত করছেন। এমন চারজন হস্তশিল্পজাত পণ্য উৎপাদনকারী নারী উদ্যোক্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁদের কারখানার চাকা আবার ঘুরছে। বিদেশ থেকে রপ্তানির চাহিদা আসা শুরু করেছে। কেউ দেশে কাজের আদেশ বা অর্ডার পেয়েছেন। কেউবা বিক্রি আর অর্ডার ধরতে ভিনদেশি অনলাইন মেলায় যোগ দিচ্ছেন।

বাংলাদেশ হস্তশিল্প প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাক্র্যাফটে সমবেত ৪৫০ জন উদ্যোক্তা। তাঁদের ৯৫ জন অর্থাৎ এক-পঞ্চমাংশ নারী। উদ্যোক্তাদের সব প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে বাংলাক্র্যাফট ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট ৪০৭ কোটি টাকা রপ্তানি আয়ের হিসাব দিচ্ছে। গত অর্থবছরে করোনার প্রভাবে রপ্তানি কমেছে। এই অর্থবছরে ৭০টি প্রতিষ্ঠান রপ্তানি করেছে ২৬৬ কোটি টাকার বেশি।

করোনাকালের শুরুতে প্রায় বন্ধ থাকার পরে সম্প্রতি কিছু কিছু করে বিক্রি বেড়েছে। গত জুলাই থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩৮টি প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬০ কোটি টাকা।

বাংলাক্র্যাফটে সমবেত ৪৫০ জন উদ্যোক্তা। তাঁদের ৯৫ জন অর্থাৎ এক-পঞ্চমাংশ নারী। উদ্যোক্তাদের সব প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে বাংলাক্র্যাফট ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট ৪০৭ কোটি টাকা রপ্তানি আয়ের হিসাব দিচ্ছে। গত অর্থবছরে করোনার প্রভাবে রপ্তানি কমেছে। এই অর্থবছরে ৭০টি প্রতিষ্ঠান রপ্তানি করেছে ২৬৬ কোটি টাকার বেশি।

ভাগ্যের চাকা ঘুরছে

তরঙ্গের কোহিনুর ইয়াসমিনের উৎপাদনকেন্দ্রগুলো আবার সচল হয়েছে গত ৫ জুন। সেই সঙ্গে ২ হাজার ৮০০ নারীর ভাগ্যের চাকাও ঘুরতে শুরু করেছে। তাঁর এই নারী কর্মীরা ঢাকাসহ ৯ জেলায় কাজ করছেন।

কোহিনুর বলছেন, করোনাকালে অনেক ক্ষতি হয়েছে, এখন অর্ডার আসতে থাকায় ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগও তৈরি হয়েছে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘অন্য সময়ের চেয়ে এবার আমি দেড় গুণ বেশি কাজ পেয়েছি। বিশেষ করে পরিবেশবান্ধব পাটের পণ্যের চাহিদা অনেক।’

নাজমা আহসানের প্রতিষ্ঠান সানট্রেড মাত্রই মার্কিন একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য বড় একটি চালানের ঝুড়ি ও ব্যাগ তৈরি করেছিল। ঠিক তখনই এল করোনাকাল। শেষ মুহূর্তে কার্যাদেশটি বাতিল হয়ে যায়। সেই দুঃখ এখন অনেকখানি কেটেছে নতুন বড় কার্যাদেশ পাওয়ার পর।

টঙ্গী, বগুড়া ও নীলফামারীতে তিনটি কারখানা এবং ওই জেলাগুলোর বিভিন্ন গ্রামের ঘরে ঘরে নাজমার প্রতিষ্ঠানের চার হাজার নারী হস্তশিল্পী কাজ করেন। গত মে-জুন মাসে পুরোনো ও নতুন মিলিয়ে দেড় মিলিয়ন ডলার অর্থাৎ পৌনে ১৩ কোটি টাকার অর্ডারের কাজ শুরু হয়েছে।

টঙ্গী, বগুড়া ও নীলফামারীতে তিনটি কারখানা এবং ওই জেলাগুলোর বিভিন্ন গ্রামের ঘরে ঘরে নাজমার প্রতিষ্ঠানের চার হাজার নারী হস্তশিল্পী কাজ করেন। গত মে-জুন মাসে পুরোনো ও নতুন মিলিয়ে দেড় মিলিয়ন ডলার অর্থাৎ পৌনে ১৩ কোটি টাকার অর্ডারের কাজ শুরু হয়েছে।

আফসানা আসিফ হস্তশিল্পজাত পণ্যের উৎপাদক কারখানা এসিক্সের ব্যবসায়িক অংশীদার। ক্ষতি সামলে ওঠার আশা করছেন আফসানা। গত মাসে ফ্রান্সে পণ্য পাঠিয়েছেন। এখন জাপানের জন্য পোষা প্রাণীদের খাবার দেওয়ার পাত্র সরবরাহের কাজ করছেন।

মোহাম্মদ আবুল কালাম স্বায়ত্তশাসিত সরকারি সংস্থা জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টারের (জেডিপিসি) নির্বাহী পরিচালক। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, তাঁর সংস্থা করোনা দুর্যোগ কাটাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ই-বিপণন চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। তাঁরা বহুমুখী পাটপণ্যের তথ্য প্রচার করবেন।

রপ্তানি করতে ৯ ধরনের কাগজপত্র জমা দিতে হয়। চাহিদাটা দুই ধরনের কাগজপত্রে নামিয়ে আনা দরকার। প্রণোদনা আরও বেশি প্রয়োজন। সব উদ্যোক্তা যেন পেতে পারেন, সে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
গোলাম আহসান, সভাপতি, বাংলাক্র্যাফট

চাই সরকারের সহযোগিতা

উদ্যোক্তারা ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সরকারে কাছে প্রণোদনা আর সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার সুযোগ চাইছেন। ‘কোভিড-১৯ মহামারিতে কুটির, অতি ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তা এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবী নারীদের অবস্থা’ জরিপ করেছে ব্র্যাক। এই শিরোনামের জরিপ প্রতিবেদনটি বেরিয়েছে গত ১৭ সেপ্টেম্বর। ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি প্রোগ্রামের উদ্যোগে অ্যাডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেঞ্জ প্রোগ্রাম এই সমীক্ষাটি পরিচালনা করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকার এই শ্রেণির শিল্প-ব্যবসার জন্য এক হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা সহায়তা ঘোষণা করেছে। তবে প্রচার না থাকায় এবং পাওয়ার পথ জটিল হওয়ায় এ উদ্যোক্তারা সেভাবে তার নাগাল পাচ্ছেন না। প্রণোদনার মাত্র ১০ শতাংশ ছাড় হয়েছে। আর ৭১ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা এ সম্পর্কে জানেনই না। বেশির ভাগ নারী উদ্যোক্তা ব্যবসার জন্য এনজিওগুলোর ক্ষুদ্রঋণের দ্বারস্থ হয়েছেন।

স্মিতা চৌধুরী ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী মণিপুরি সম্প্রদায়ের মানুষ। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম ব্রিন্তা। তিনি শুধু পাটের পণ্য বানান। গত বছর জাপানে তিন দফায় ৭০ লাখ টাকার পণ্য রপ্তানি করেছিলেন। গত ফেব্রুয়ারিতে শেষ চালান গিয়েছে ২৫ লাখ টাকার। গাজীপুরে ব্রিন্তার কারখানা। কর্মী হালিমা খাতুন বলেন, দুই মাস কাজ বন্ধ ছিল। জুন থেকে পাটের তৈরি বিভিন্ন পণ্য বানানো শুরু করেছেন। এসিক্সের আফসানা বললেন, তিনি কর্মীদের বেতন বাবদ ৪ শতাংশ সুদে প্রণোদনার ১৫ লাখ টাকা পেয়েছেন। জানুয়ারি থেকে ঋণ পরিশোধের শর্ত রয়েছে।

বাংলাক্র্যাফটের সভাপতি গোলাম আহসান প্রথম আলোকে বলেন, এই সংকটের মধ্যেও বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা কাজ পেয়েছেন এবং করছেন। তবে এখন উৎপাদনের খরচ অনেক বেড়ে গেছে। পণ্য পরিবহনেও ব্যাঘাত ঘটছে। এখন সরকারের মনোযোগ খুবই দরকার। গোলাম আহসান আরও বলেন, রপ্তানি করতে ৯ ধরনের কাগজপত্র জমা দিতে হয়। চাহিদাটা দুই ধরনের কাগজপত্রে নামিয়ে আনা দরকার। প্রণোদনা আরও বেশি প্রয়োজন। সব উদ্যোক্তা যেন পেতে পারেন, সে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।