জেসিকা অ্যালবার বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি

ডার্ক অ্যানজেলে জেসিকা অ্যালবা

ইউটিউবের কল্যাণে অনেকেই জেমস ক্যামেরনের মার্কিন টিভি সিরিজ ডার্ক অ্যানজেল দেখেছেন। ২০০০ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত প্রচারিত হলেও এর শুটিং হয় ১৯৯৮ সালে। ছবির গল্পে ভবিষ্যতে (২০০৯ সালের) জেনেটিক্যালি সুপার পাওয়ার একজন সৈনিক ব্যারাক থেকে পালিয়ে যায় এবং সাধারণ মানুষ হিসেবে জীবনযাপনের চেষ্টা করে। ঘটনাময় এই চ্যালেঞ্জিং চরিত্রের জন্য ক্যামেরন অভিজ্ঞ ও ক্যারিশমাটিক কাউকে না নিয়ে নেন ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরীকে, যে কিনা এর আগে মাত্র দুটি ছবিতে অভিনয় করেছে। নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে, সপ্তাহে ৮৬ ঘণ্টা পরিশ্রম করে ওই চরিত্রটি অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তোলেন ওই কিশোরী, জেসিকা অ্যালবা। ওই সিরিজের পর জেসিকা হলিউডে একজন শক্তিশালী অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন, ‘জাহানি’, ‘সিন সিটি’, ‘ফ্যান্টাস্টিক ফোর’, ‘ইনটু দ্য ব্লু’, ‘ফ্যান্টাস্টিক ফোর: রাইজ অব দ্য সিলভার সার্ফার’ ও ‘গুড লাক চাক’ নিয়ে জেসিকা তরতর করে উঠে আসেন। একাধিক পুরস্কার ও গোল্ডেন গ্লোবের জন্য মনোনয়নও পান।

২০০৯ সালেই তার প্রথম সন্তানের জন্মের সময়ের কথা। পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের আয়োজনে ‘বেবি শাওয়ার’ অনুষ্ঠানে জেসিকা বেশ কটি ঢিলেঢালা জামা (প্রেগন্যান্সি ম্যাক্সি) উপহার পান। জেসিকার মা তার সংবেদনশীল মেয়েকে এগুলো পরার আগে ভালো ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুয়ে নিতে বলেন। জেসিকা তাই করলেও অ্যালার্জি থেকে মুক্তি পেলেন না। তাঁর সারা শরীর লাল লাল চাকায় ভরে গেল। জেসিকার ছোটবেলাতে প্রায়ই এই সমস্যা হতো, হাসপাতালেও কাটাতে হতো। এর মনে হলো, তাঁর ছোট্ট সন্তানের যখন কোনো অ্যালার্জি হবে বা কোনো ডিটারজেন্ট বা সাবান তার শরীরে জুত হবে না, তখন কী হবে? উদ্বেগে উৎকণ্ঠিত জেসিকা রাতে না ঘুমিয়ে গুগল আর উইকিপিডিয়া থেকে জেনে আরও আতঙ্কিত হয়ে গেলেন। জানলেন মেঝের ক্লিনার থেকে ফ্লোরম্যাট বা প্রায় সব গেরস্তালি পণ্যে পেট্রোকেমিকেল, ফরমালডিহাইড ও আগুন প্রতিরোধী উপকরণের কথা পণ্যের গায়ে সগৌরবেই লেখা থাকে। আর বাকি বিষাক্ত উপকরণকে আইন অনুসারে ‘সুগন্ধী’ বলে চালিয়ে দেওয়া হয়।

জেসিকা অ্যালবা

২০০৯ সালে মেয়ের জন্মের পর জেসিকা সাশ্রয়ী, সুন্দর ডিজাইন কিন্তু নিরাপদ শিশু-সামগ্রীর খোঁজ করে ব্যর্থ হন। মনের দুঃখে নিজেই এসব পণ্য বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। কিন্তু বেকিং সোডা, ভিনেগার ও তেল দিয়ে ক্লিনিং জেল বানাতে গেলে সেটি হয়ে যায় সালাদ ড্রেসিং! হা হতোম্ভি।

এরপর জেসিকা খোঁজ পেলেন হেলদি চাইল্ড, হেলদি ওয়ার্ল্ড নামে এনজিওর প্রতিষ্ঠাতা ক্রিস্টোফার গাভিগানের। গাভিগান সারা বছর শিশুদের জন্য নিরাপদ পণ্যের আন্দোলন করছেন। গাভিগানকে সঙ্গে নিয়ে জেসিকা তৈরি করেন তাঁর ব্যবসা পরিকল্পনা। হাজির হলেন স্বামীর বন্ধু, অ্যানজেল বিনিয়োগকারী, ব্রায়ান লির কাছে। ব্রায়ান জেসিকার ৫০ স্লাইডের উপস্থাপনা মনোযোগ দিয়ে শোনেন কিন্তু ‘বাজারে চাহিদা নেই’ বলে সেটি নাকচ করে দেন! প্রত্যাখ্যাত জেসিকা ফিরে আসেন, তবে হতোদ্যম হলেন না।

ব্রায়ান জেসিকার ৫০ স্লাইডের উপস্থাপনা মনোযোগ দিয়ে শোনেন কিন্তু ‘বাজারে চাহিদা নেই’ বলে সেটি নাকচ করে দেন! প্রত্যাখ্যাত জেসিকা ফিরে আসেন, তবে হতোদ্যম হলেন না

শুরু করলেন এ বিষয়ের আরও গভীরে যাওয়া। অভিনয়ের পাশাপাশি নিজের জানাকে সমৃদ্ধ করলেন। ২০১১ সালে জেসিকাকে দেখা যায় আমেরিকার ১৯৭৬ সালের বিষাক্ত দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের পরিমার্জনের জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে। ওই আইনে মাত্র ১১টি উপকরণকে গৃহস্থালি পণ্যের জন্য নিষিদ্ধ করা আছে। অথচ একই বিষয়ের ইউরোপের আইনে সেই সংখ্যাটি ১৩০০! এরই মধ্যে নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জেসিকা নিরাপদ শিশুবান্ধব পণ্যের জন্য সোচ্চার হওয়া শুরু করেছেন।

২০১১ সালেই জেসিকা আবার ব্রায়ান লির কাছে ফিরে গেলেন। এবার অনেক উপাত্ত, বিশ্লেষণ, শিশু বিশেষজ্ঞদের অভিমত এবং মাত্র ১০টি স্লাইডের উপস্থাপনা! অন্যদিকে ব্রায়ানও তখন নতুন বাবা হয়েছেন আর প্রতিদিনই স্ত্রীর কাছে এই বিষয়গুলো শুনছেন। কাজেই এবার জেসিকার পরিকল্পনার পক্ষে মত দিলেন। ব্রায়ান লি প্রাইসগ্র্যাবার ডটকম থেকে শিন কেইনকে নিয়ে এলেন। জেসিকা, গাভলিন, শিন আর ব্রায়ান মিলে হয়ে গেলেন ‘ফ্যান্টাস্টিক ফোর’ আর তাদের কোম্পানির নাম হলো ‘অনেস্ট’। জোগাড় হলো ৬০ লাখ বা ৬ মিলিয়ন ডলারের প্রারম্ভিক মূলধন। শিন প্রধান নির্বাহী, জেসিকা হলেন টেস্টিং আর মার্কেটিং বিভাগের প্রধান।

বাকি থাকল পণ্য। অনেকেই একটিমাত্র পণ্যের কথা বললেও জেসিকা শুরু থেকে ‘লাইন অব প্রোডাক্ট’ থেকে সরলেন না। ২০১২ সালে ১৭ রকমের ডায়াপার ও ওয়াইপ নিয়ে বাজারে আসে অনেস্ট। শুরুটা ই-কমার্সে। সঙ্গে সাবস্ক্রাইবার পদ্ধতি। প্রতি মাসে গ্রাহকদের বাসাতে প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হয়। ২০১২ সালে বিক্রি হয়ে গেল ১০ মিলিয়ন ডলারের সামগ্রী।

অনেস্টের পণ্য ও জেসিকা অ্যালবা

দ্রুত বাড়তে থাকল অনেস্টের পণ্যের সংখ্যা, সঙ্গে বিক্রিও। ২০১৫ সালেই ১৩২ রকমের পণ্য নিয়ে বিক্রি দাঁড়াল ১৫০ মিলিয়ন ডলারে। আর অনেস্ট হয়ে গেল বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি! কর্মীর সংখ্যা প্রায় ৫০০ আর অনলাইন ছাড়াও প্রায় ৪ হাজার ৪০০ খুচরা দোকান থেকে বিক্রি।

কিন্তু এরপরই পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ করতে গিয়ে বিপদে পড়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি। বেশি পণ্যের কারণে মান নিয়ন্ত্রণ কমে যায়। হতে থাকে নানান রকম ভুল। ২০১৭ সালে কোম্পানির ভ্যালুয়েশন বিলিয়ন ডলার থেকে নিচে নেমে যায়।

নিজের ভুল বুঝতে পরে জেসিকা ও তার দলবল আবারও নিজেদের সীমিত করে ফেলে শিশুপালন, সৌন্দর্য ও লাইফস্টাইল পণ্যে। নেওয়া হয় নতুন প্রধান নির্বাহী। গুরুত্ব দেওয়া হয় পণ্যের মানে এবং বাড়ানো হয় নিবিড় তদারকি। আবারও ঘুরে দাঁড়ায় জেসিকা অ্যালবা। অনেস্ট পৌঁছে যায় ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের কোম্পানিতে।
অভিনেত্রী থেকে উদ্যোক্তা হয়ে বিলিয়ন ডলারের স্টার্টআপ গড়ার ক্ষেত্রে জেসিকা অ্যালবার অনেস্ট থেকে হবু উদ্যোক্তাদের শেখার আছে অনেক কিছু। প্রথমত, নিজের মিশন আর অঙ্গীকারের কোনো বিকল্প নেই। বিকল্প নেই পরিশ্রম ও সততার।

বৈচিত্র্যের দরকার আছে, তবে সেটা মূল লক্ষ্যে আর উদ্দেশ্যের সঙ্গে মিল রেখে। গড়ে তুলতে হবে নিজস্ব সম্প্রদায়, যারা উদ্যোক্তা লক্ষ্য ও উদ্দ্যশের সঙ্গে একাত্ম থাকবেন। তাহলেই কেবল গড়ে তোলা যাবে বিলিয়ন ডলারের স্টার্টআপ।