দরজি আনোয়ারের শিঙাড়াওয়ালা হওয়া

একটা ছোট হাতে টানা বা ঠেলাগাড়ি, তার মধ্যেই গ্যাস স্টোভ আর বিকেলের ভাজাপোড়া বানানোর সরঞ্জাম। এই নিয়েই আনোয়ারের ছোট ব্যবসা। কারওয়ান বাজারের মসলার পাইকারি বাজারের সরু গলিতে ছোট্ট এক কিনারায় দোকান নিয়ে বসেন তিনি। একা হাতেই বিকেলের ভাজাপোড়া বানান, বিক্রি করেন। বিকেল ৫টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা-১০টা পর্যন্ত।

আনোয়ার একজন ভাসমান পেশাজীবী। করোনার আগে তাঁর একটা স্থায়ী পেশা ছিল। রাজধানীর শাহজাহানপুরে দরজির দোকান করতেন। নিজের দোকান, ব্যবসাও মন্দ ছিল না। এই দোকান দিয়েই বিয়ে করেছিলেন, ছেলেও স্কুলে যেত। কিন্তু করোনার প্রথম ধাক্কায় তাঁর সবটুকু ভেসে যায়। সংক্রমণ ঠেকাতে সব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এতে বন্ধ হয়ে যায় তাঁর কাজ। এরপর সবজির ফেরিওয়ালা, ফলের ফেরিওয়ালা থেকে আপাতত থিতু হয়েছেন শিঙাড়া ব্যবসায়।

‘যখন সব বন্ধ হয়ে গেল, কোনো কাজ ছিল না, প্রতি সপ্তাহ ভাবতাম, সামনের সপ্তাহ থেকে সব ঠিক হয়ে যাবে।’ কিন্তু যত দিন বাড়ছিল, বাড়ছিল দেনা। দোকানের ভাড়া বাকি পড়ে। বাড়িভাড়াও। জমানো টাকা দিয়ে খাওয়ার খরচ হয় না। ‘আমার পরিবার (স্ত্রী) কোনো দিন চাকরি করে নাই। আমাদের ওইখানে যারা কাজ পায় না, তাদের পরিবার বাসায় কাজ শুরু করে। আবার চাকরি-বাকরি হলে পরিবার কাজ ছেড়ে দেয়। কিন্তু তখন বাসায় কাজও ছিল বন্ধ,’ বললেন আনোয়ার।

এভাবে একদিন হাতের সব টাকা শেষ হয়ে যায় আনোয়ারের। ইতস্তত কাজ খুঁজতে থাকেন এখানে-সেখানে। কখনো সবজি ফেরি করেন, কখনো ফল। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে কারওয়ান বাজারে আসেন তিনি। বললেন, ‘বাজার থেকে আমি ফল নিতাম, সেগুলো বিক্রি করতাম। খুব একটা লাভ হতো না। পথে মানুষ নাই, কিনবে কে? মানুষ সব বাজারে। ভাবলাম বাজারে কিছু বিক্রি করা যাক।’ এক প্রতিবেশী ১৬০০ টাকায় একটা হাতগাড়ির ব্যবস্থা করে দিলেন। চার কেজি আলু কিনে মসলাপাতি নিয়ে আনোয়ার সাহস করে বাজারে নামলেন, শিঙাড়া বানিয়ে বিক্রি করা যায় কি না, বুঝতে।

ভাগ্যই বলতে হবে আনোয়ারের। একটু একটু করে ব্যবসা জমে গেল। একজন দোকানি তাঁর দুই দোকানের মাঝের সরু পথে গাড়ি নিয়ে দাঁড়াতে দিলেন। বাজারের বিক্রেতারা, পথচলতি মানুষ, আশপাশের অফিসের কর্মজীবীদের কাছে ক্রমেই জনপ্রিয়তা বাড়ছে আনোয়ারের।

আনোয়ার প্রায় কৈশোর থেকে দরজি পেশায়। এর বাইরে কোনো কাজ পারেন না। শিঙাড়া হলো বটে কিন্তু কেউ কিনল না। এরপর আবার ভেসে যাওয়া। আনোয়ার এক শিঙাড়া-পুরির দোকানে দিনমজুরির ভিত্তিতে সাহায্যকারীর কাজ নিলেন। ‘সেখানে বসে বোঝার চেষ্টা করতাম, কীভাবে শিঙাড়া-পুরির খামিন বানায়, কী দেয়, কতক্ষণ ভাজে।’ এই জ্ঞান পুঁজি করে আবার কারওয়ান বাজারে চলে এলেন শিঙাড়া বিক্রি করতে।

ভাগ্যই বলতে হবে আনোয়ারের। একটু একটু করে ব্যবসা জমে গেল। একজন দোকানি তাঁর দুই দোকানের মাঝের সরু পথে গাড়ি নিয়ে দাঁড়াতে দিলেন। বাজারের বিক্রেতারা, পথচলতি মানুষ, আশপাশের অফিসের কর্মজীবীদের কাছে ক্রমেই জনপ্রিয়তা বাড়ছে আনোয়ারের। শিঙাড়া, পুরি, পেঁয়াজু মিলিয়ে তাঁর প্রতিদিনের বিক্রি ৫০০ পিস। সব খরচ মিটিয়ে পাওয়া যায় ৮০০ থেকে হাজার টাকা, একজন কর্মচারীও রেখেছেন। এতটুকুতে জীবন চলে যায়, তবে আনোয়ার ঘর পোড়া গরু। দুপুরের পরের সময় শিঙাড়ার ব্যবসা, দিনের বাকি সময় আনোয়ার কাজ করেন অন্য একটা দরজির দোকানে।

‘হাতে টাকা যতটুকু রাখা যায় ভালো, এই যে আবার করোনা বেড়ে গেছে, এবার যদি এই কাজও চলে যায়!’ সামনে কী করতে চান? প্রশ্ন করলে আনোয়ার জবাব দেন, ‘রোজায় ইফতারি বিক্রি করতে চাই।’ এর থেকে বেশি তিনি কিছু ভাবতে পারেন না। আবার বেড়েছে সংক্রমণ। এভাবে যদি টিকে থাকতে পারেন, তবে ছেলেটার স্কুল বন্ধ হবে না। এখন শুধু এতটুকুই জানেন আনোয়ার।