দেশীয় শিল্পের পথপদর্শক একজন আনোয়ার হোসেন

গত মঙ্গলবার রাতে ধানমন্ডির একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। দেশের পুরোনো উদ্যোক্তাদের একজন তিনি। প্রতিষ্ঠা করেছেন ২০টির বেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। যেখানে বর্তমানে ২০ হাজার কর্মী কাজ করছেন। তবে অনেকেই তাঁকে মালা শাড়ির আনোয়ার হোসেন নামেই চেনেন।

আনোয়ার হোসেন (জন্ম: ১৯৩৮, মৃত্যু: ২০২১)

স্বাধীনতার আগে বাঙালিদের মধ্যে বড় ব্যবসায়ীর সংখ্যা ছিল খুবই কম। শিল্পোদ্যোক্তা ছিল হাতে গোনা। আনোয়ার হোসেন ছিলেন তাঁদেরই একজন। দেশীয় ব্র্যান্ডের জনপ্রিয় মালা শাড়ি থেকে শুরু করে দেশীয় মালিকানার বস্ত্রকল, চামচ-কাঁটাচামচ, বেসরকারি ব্যাংকের মতো নতুন নতুন উদ্যোগে তিনি ছিলেন অগ্রণী।

দেশের সফল এই শিল্পোদ্যোক্তা গত মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর একটি হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। ২০১২ সালে স্মৃতিশক্তি হারানোর রোগ বা ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত হন তিনি। তার আগেই নিজের হাতে গড়ে তোলেন বস্ত্র, পাট, সিমেন্ট, ইস্পাত, আবাসন, পলিমার, আসবাব, অটোমোবাইল, ব্যাংক ও আর্থিক খাতের ২৬ প্রতিষ্ঠান। কর্মসংস্থান হয় ১৪ হাজার মানুষের। তাঁর সন্তানদের হাত ধরে বেশ ভালোভাবে এগিয়ে চলেছে আনোয়ার গ্রুপ। বর্তমানে শিল্পগোষ্ঠীর ২০ কোম্পানিতে ২০ হাজারের বেশি কর্মী রয়েছে।

আনোয়ার হোসেনের জন্ম ১৯৩৮ সালে। তাঁদের পারিবারিক ব্যবসার শুরু তারও ১০৪ বছর আগে, ১৮৩৪ সালে। ওই বছর তখনকার কুন্ডু রাজার কাছ থেকে চকবাজারে বছরে এক টাকা খাজনায় একটি ভিটা ইজারা নেন আনোয়ার হোসেনের দাদা লাক্কু মিয়া (আসল নাম লাট মিয়া)। এই ইজারার দলিলপত্র এখনো সংরক্ষিত আছে। ফলে এখন আনোয়ার হোসেনের পরিবারের ব্যবসার বয়স দাঁড়িয়েছে ১৮৫ বছর।

আনোয়ার হোসেনের নিজের ব্যবসা শুরু ১৯৫৩ সালে। এর আগে কয়েক বছর তিনি পারিবারিক ব্যবসা সামলেছেন। ৪৮০ টাকায় চকবাজারে ২২০ নম্বর দোকান নেন। নাম দেন আনোয়ার ক্লথ স্টোর। তাঁর বয়স তখন মাত্র ১৫ বছর। তখন ঢাকার রায়েরবাজারে হাট বসত। সেখানে তিনি লুঙ্গির গাঁটরি মাথায় করে নিয়ে যেতেন। পরনে লুঙ্গির ভাঁজে থাকত মুড়ি আর পেঁয়াজি। খিদে পেলে তাই খেতেন। ব্যবসা বাড়তে থাকে। একসময় চকবাজারে পাশের ছয়টি দোকান কিনে নেন আনোয়ার হোসেন। লুঙ্গি থেকে কাপড়, এরপর শাড়ি, ব্যবসা বাড়ছিল। আনোয়ার হোসেন নামেন ঢেউটিন আমদানির ব্যবসায়—সবই ১৯৫৩ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে।

বাণিজ্যে ভালো করছিলেন ঠিকই, কিন্তু আনোয়ার হোসেনের ইচ্ছা ছিল শিল্পকারখানা করার। ১৯৫৬ সালে বাড়িতে শাড়ির ছাপাখানা চালু করেছিলেন। সেটা সেই অর্থে শিল্প ছিল না। ১৯৬৮ সালে তিনি একটি সিল্ক মিল কিনে নিয়ে চালু করলেন আনোয়ার সিল্ক মিলস। তৈরি হলো মালা শাড়ি। এটিই বাংলাদেশের শাড়ির জগতে প্রথম সুপরিচিত ব্র্যান্ড। দেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে এই শাড়ি এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, বিয়ে মানেই ছিল মালা শাড়ি। আশির দশকেও বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটি জনপ্রিয় জিঙ্গেল ছিল ‘মালা শাড়ি না দিলে বিয়া করমু না’।

শিল্প উদ্যোক্তার পাশাপাশি ব্যবসায়িক সংগঠনের নেতৃত্বেও এগিয়ে ছিলেন আনোয়ার হোসেন। তিনি চার মেয়াদে ঢাকা চেম্বারের পরিচালক ছিলেন। ঢাকা চেম্বার ফাউন্ডেশনেরও প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান। রাজনীতিতে যোগ দিয়ে তিনি ঢাকা-৮ আসনের সাংসদ নির্বাচিত হন। তিন বছর দায়িত্ব পালন করেন। এরপর এরশাদের পতন হয়।

আমার আট দশক নামে আনোয়ার হোসেনের একটি আত্মজীবনী গ্রন্থ রয়েছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত উপন্যাসের নামে আত্মজীবনীতে শেষ অনুচ্ছেদের নাম দিয়েছেন শেষের কবিতা। উপন্যাস থেকে উদ্ধৃত করে তিনটি লাইন লিখেছেন, ‘তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান; গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়। হে বন্ধু, বিদায়।’