একজন সচিবের আয়কর দেওয়ার গল্প

আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন দেওয়ার সময় বেড়েছে। পুরো ডিসেম্বর মাসজুড়ে দেওয়া যাবে। আয়কর দেওয়ার এই বাড়তি মাসে এক সাবেক সচিবের আয়কর দেওয়ার গল্পটা বলা যেতে পারে।

১.

নাসিম উদ্দিন আহমেদ সিএসপি কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৯১ সালে অর্থসচিব হিসেবে যোগ দেওয়ার আগে ছিলেন যোগাযোগসচিব। গল্পটা সেই সময়ের। তাঁরা ছিলেন দুই যমজ ভাই, অত্যন্ত ধনী পরিবারের সন্তান। আজিম উদ্দিন আহমেদ ও নাসিম উদ্দিন আহমেদ। দুজনই সিএসপি, দুজনই একই সঙ্গে সরকারের সচিব। দুজনই ছিলেন চিরকুমার। বলা যায়, সচিবালয়ের উল্টো দিকে সেগুনবাগিচার প্রায় অর্ধেকের মালিকই ছিলেন তাঁরা। সৎ কর্মকর্তা হিসেবে দুই ভাইয়েরই সুনাম ছিল।

নাসিম উদ্দিন আহমেদ নিয়মিত আয়কর দিতেন। যোগযোগসচিব থাকাকালীন তাঁর একান্ত সচিব ছিলেন সিরাজ উদ্দিন সাথী। ‘আমলাতন্ত্রের অন্দরমহলের বত্রিশ বছর’ বইয়ে তিনি নাসিম উদ্দিন আহমেদের আয়কর রিটার্ন দেওয়ার অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন।
নাসিম উদ্দিন আহমেদের ট্যাক্স ফাইল দেখাশোনা করতেন এক আয়কর আইনজীবী, নাম মিজানুর রহমান। তিনি একসময় আয়কর কর্মকর্তা ছিলেন, সাবেক কমিশনার। মিজানুর রহমান একদিন দেখা করলেন একান্ত সচিবের সঙ্গে। সচিবের স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া আছে, আয়ের সব হিসাব দেখাতে হবে, এবং পুরো আয়কর দিয়ে দিতে হবে। প্রতিবারই তা–ই হয়, কিন্তু এবার বিপত্তি দেখা দিয়েছে। এবারের সমস্যাটি অন্য রকম। ট্যাক্স ফাইল নিষ্পত্তি না করে আয়কর অফিস ফাইল আটকে রেখেছে। কিন্তু সে কথা তিনি সচিব নাসিম উদ্দিন আহমেদকে বলতে সাহস পাচ্ছেন না।

আরও পড়ুন

ঝামেলাটি বেধেছিল নতুন প্রবর্তিত ‘গেইন ট্যাক্স’ নিয়ে। সেবারই সরকার ভূসম্পত্তির ওপর এই নামে ট্যাক্স ধার্য করেছিল। অর্থাৎ জমি বিক্রি করলে বর্ধিত দামের ওপর কর দিতে হবে। নাসিম উদ্দিন আহমেদ সেগুনবাগিচার একটি পৈতৃক বাড়ি বিক্রি করেছেন। পাঁচ কাঠা জমির ওপর দোতলা বাড়ি, আজিম ভিলা। কিনেছেন পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত আইজি এম এ হক, ৪০ লাখ টাকায়।

নিয়ম মেনে বিক্রির তথ্য আয়কর ফাইলে দেওয়া হয়েছে। মিজানুর রহমান নিজেই আয়কর অফিসে বেশ কয়েকবার ছোটাছুটি করেছেন, কিন্তু তাঁর কথাই শুনছেন না তাঁরই একসময়ের সহকর্মীরা। জানতে চাইলেই বলেন, ‘সচিব স্যার এত টাকা গেইন ট্যাক্স দেবেন কেন? কেউ কি এত টাকা দেয়? স্যারকে বলেন, আমরা ট্যাক্স কমিয়ে দেব, ইত্যাদি।’ আসল কথা হচ্ছে তাঁরা টাকা চান, ঘুষ পেলে ট্যাক্স কমিয়ে দেবেন।

ব্যাপারটি দেখতে একান্ত সচিব সিরাজ উদ্দিন নিজেই গেলেন ট্যাক্স অফিসে। সেই অফিস সেগুনবাগিচায়, সচিবের বাড়ির ঠিক পাশেই। এটাও নাসিম উদ্দিন আহমেদেরই পৈতৃক সম্পত্তির অংশ। আয়কর উপকমিশনার বশির উদ্দিন, একান্ত সচিবেরই ব্যাচমেট। সমস্যার কথা বলতেই অধস্তনদের ডেকে কথা বললেন, ফাইল আনলেন। অধস্তনরা বললেন, ‘স্যার কেন এত টাকা ট্যাক্স দিতে যাবেন। এই তো জানালা দিয়ে স্যারের বাসা দেখা যায়। স্যারের কাছ থেকে কি আমরা এত টাকা নিতে পারি।’

এ প্রসঙ্গে সিরাজ উদ্দিন সাথী লিখেছেন, ‘আমি অনেকটা খেপে গেলাম। বললাম, এ কী কথা? তিনি ট্যাক্স দিতে চাচ্ছেন, আর আপনারা তা নিতে চাচ্ছেন না। তিনি যখন দিতে চান, আপনাদের নিতে আপত্তি কেন? আর তিনি কি নয়ছয় করার লোক? আমার এই কথায় বশির উদ্দিনের সম্ভবত সংবিৎ ফিরল। তিনি তাঁদের থামিয়ে বললেন—ঠিক আছে, আমি দেখছি বিষয়টা। কাজ শেষ করে এরপর সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে মনে বললাম, ট্যাক্স অফিসের বোধ হয় সমস্যা এটাই। তারা গায়ে পড়ে সবার ভালো দেখতে যায়। এত ভালো বোধ হয় ভালো নয়!’

কাজ শেষ করে এরপর সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে মনে বললাম, ট্যাক্স অফিসের বোধ হয় সমস্যা এটাই। তারা গায়ে পড়ে সবার ভালো দেখতে যায়। এত ভালো বোধ হয় ভালো নয়!’

২.
তখনো যোগাযোগসচিব নাসিম উদ্দিন আহমেদ। মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিদেশি অর্থায়নে অনেক প্রকল্প। নতুন নতুন প্রকল্প নিয়ে কথা বলতে বিদেশিরা প্রায়ই আসেন, আসেন দাতা সংস্থা, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপানিজ উন্নয়ন সংস্থা, চীনা রাষ্ট্রীয় সংস্থার প্রতিনিধিরা। আরও আসেন বিদেশি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা। তাঁরা দেখা করেন মন্ত্রী ও সচিবের সঙ্গে, আসার সময় নানা উপহার নিয়ে আসেন।

তবে উপহার গ্রহণ সম্পর্কে সরকারি একটি নিয়ম আছে। বিধিটি হলো, সরকারি কোনো কর্মকর্তা সৌজন্য রক্ষার খাতিরে উপহার নিতে বাধ্য হলে তা গ্রহণ করবেন। কিন্তু বিষয়টি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে জানাতে হবে এবং উপহারসামগ্রীটি ওই বিভাগের তোষাখানায় জমা দিতে হবে। তবে যদি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা উপহার সামগ্রীটি পছন্দ করে তা রাখতে চান, তাহলে তোষাখানায় জমা দিয়ে তাঁর ইচ্ছার কথা জানাতে হবে। এরপর সরকার এর মূল্য নির্ধারণ করে দেবেন। সরকারি কোষাগারে নির্ধারিত মূল্য জমা দিয়ে ওই জিনিস নিজের ব্যবহারে নিতে পারবেন।

প্রতিবারই পাওয়া উপহার জমা দেওয়া হয় তোষাখানায়। তবে একবার কী ভেবে চীনাদের দেওয়া হাতের কারুকার্য করা এক পিস কাপড় পছন্দ করলেন নাসিম উদ্দিন আহমেদ। একান্ত সচিবকে ডেকে বললেন, ‘এটা আমি রাখতে চাই। কেবিনেট ডিভিশনে লিখে অনুমতি নেন।’

এরপর সিরাজ উদ্দিন তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘আমি কাপড়টি কেবিনেট ডিভিশনে পাঠালাম। নিয়মমাফিক তোষাখানার লোকেরা এর মূল্য নির্ধারণের জন্য মার্কেটে পাঠাল। তারপর একদিন চিঠি দিয়ে জানাল, কাপড়টির মূল্য নির্ধারণ হয়েছে সাড়ে তিন হাজার টাকা। এত দাম এই কাপড়খানির? জিজ্ঞাসা করলাম তোষাখানার অফিসারকে, কীভাবে আপনারা এই মূল্য নির্ধারণ করলেন? তিনি বললেন, একজন স্টাফ কাপড়টি নিয়ে বাজারে গিয়ে দোকানিদের জিজ্ঞাসা করেছেন, এমন একটি কাপড় কিনতে কত লাগবে। দোকানদার বলেছেন, তিন-সাড়ে তিন হাজার টাকা। এই হলো মূল্য নির্ধারণের সরকারি পদ্ধতি।

সচিবকে চিঠিটি দেখিয়ে বললাম, নির্ধারিত মূল্য বেশি বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে। এটা কি এত টাকা জমা দিয়ে আনব? তিনি বললেন, কী করবেন, রাখতে যখন চেয়েছি, তখন নিয়ে আসেন। আর এই মূল্য তো যাবে সরকারের ঘরেই।’

আরেকবার জাপানিদের কাছ থেকে পাওয়া এক সেট পোর্সেলিন নিয়েও একই ঘটনা ঘটেছিল। এ নিয়ে সিরাজ উদ্দিন লিখেছেন, ‘কেবিনেটের তোষাখানা শাখার দায়িত্ব পালনকারী অফিসারের সঙ্গে একদিন কথা বললাম। তিনি আমাকে বললেন, স্যার কেন যে এগুলো আমাদের কাছে পাঠান। আর কেউ তো পাঠায় না। আমি বললাম, দেশের আইন তো এমনটাই।

ভদ্রলোক হাসলেন আমার কথা শুনে। খানিক পরে বললেন, দেশের প্রেসিডেন্টই ওই আইন মানেন না, যে দেশের মন্ত্রী বাহাদুরগণ একে গ্রাহ্য করেন না, অন্য কেউ এই নিয়মের তোয়াক্কা করেন না, সে দেশে দু–একজন এই আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কী করবেন? তিনি আরও বললেন, বঙ্গভবনে প্রতিনিয়ত এমন উপহার আসে। কিন্তু আজ পর্যন্ত একটা উপহারও তোষাখানায় আসেনি কিংবা এ বিষয়ে কোনো কিছু অবহিতও করা হয়নি।

ফিরে এসে কথাগুলো জানালাম। সব শুনে নাসিম উদ্দিন বললেন, অন্য কেউ কী করলেন, সে দিকে তাকাবেন না, নিজে সঠিক কাজটি করুন। আপনি সঠিক কাজ করছেন, সে বিষয়ে আপনার সন্তুষ্টি থাকা চাই।’

সচিব তাকে বললেন, বাক্সে কী আছে, তা তো বলিনি আপনাকে। বাক্সটিতে আছে বেশ কিছু বোতল বিদেশি মদ। তাঁরা জানেন আমি মদ পান করি। তাই হয়তো পাঠিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা জানেন না যে আমি মদ উপহার নিই না।

৩.
একবার এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের প্রধান কনসালট্যান্ট এক বাক্স উপহার দিয়ে গেলেন সচিবের সেগুনবাগিচার বাসায়। রাতে নাসিম উদ্দিন আহমেদ বাসায় এসে তা দেখলেন। পরদিন অফিসে এসেই ডেকে পাঠালেন একান্ত সচিবকে। পরামর্শক ভদ্রলোক ভারতীয় নাগরিক, নাম বি কে গুপ্ত। তাঁকে সব ফেরত পাঠাতে হবে। আবার এমন ‍উপহার, তা সরকারি তোষাখানায়ও দেওয়া যাবে না।

এরপর সিরাজ উদ্দিন তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘সচিব তাকে বললেন, বাক্সে কী আছে, তা তো বলিনি আপনাকে। বাক্সটিতে আছে বেশ কিছু বোতল বিদেশি মদ। তাঁরা জানেন আমি মদ পান করি। তাই হয়তো পাঠিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা জানেন না যে আমি মদ উপহার নিই না। এ কথাটা নরম ভাষায় মি. গুপ্তকে বলে আসবেন, যাতে ভবিষ্যতে এমনটা আর না হয়। তারপর তাঁর বাসা থেকে উপহারের বাক্সটি গাড়িতে তুলে নিয়ে বি কে গুপ্তের অফিসে গেলাম। বললাম, এই উপহার তিনি গ্রহণ করতে পারছেন না বলে দুঃখিত। তিনি মদ পান করেন, কিন্তু উপহার নেন না।’ বি কে গুপ্ত সত্যিই অবাক হলেন।

৪.
ঘটনাগুলো ৩০ বছর আগের। কিন্তু এ রকম উদাহরণ দেওয়ার মতো ঘটনা কি এখন আছে? কানাডার বেগম পাড়ায় সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়ি-বাড়ির সংখ্যা বেশি কিংবা দামি ঘড়িতে সময় দেখছেন, বিশিষ্টজনদের এ রকম অসংখ্য ছবি দেখার পর এই প্রশ্ন কিন্তু করাই যায়।