এবার গাড়ি বিক্রিতে ‘ফেসবুক লাইভ’
অবসর সময়ে বা কাজের ফাঁকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢুঁ মারেন না, এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। বিনোদনের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন ব্যবসার ক্ষেত্রও বটে। বিনোদন বা সংবাদের খোঁজে ঘুরতে ঘুরতে হয়তো পেয়ে যেতে পারেন নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রসাধনী অথবা আকর্ষণীয় কোনো পোশাকের প্রচারণা বা লাইভ ভিডিও। তাই বলে গাড়ি! আজকাল গাড়ির ব্যবসাও জমে উঠছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
করোনার সময়ে বাসায় বসে কেনাকাটায় অভ্যস্ত হয়েছেন অনেকেই। আর এই সুযোগ নিতে বসে নেই গাড়ি ব্যবসায়ীরাও। গাড়ির বৈশিষ্ট্য, কেন কিনবেন, কীভাবে কিনবেন, তা জানিয়ে লাইভের পাশাপাশি জানাচ্ছেন নিজেদের আকর্ষণীয় অফারও। এমনি একটি ফেসবুক লাইভ দেখে গাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত নেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জেনিস ইন্টারন্যাশনালের সহকারী ব্যবস্থাপক নাভিদ সুলতান।
টয়োটা অ্যাকুয়া ২০১৫ মডেলের গাড়িটি তিনি রাজধানীর মাটিকাটায় অবস্থিত মটো সলিউশন থেকে অগ্রিম বুকিং দেন। এর আগে ফেসবুক লাইভে গাড়িটি দেখে তিনি পছন্দ করেন। পরে আরও কয়েকটি গাড়ি বিক্রয়কেন্দ্র যাচাই করে নিজের পছন্দের গাড়িটি বুঝে নেন।
সাধারণ ছুটির সময়টিতে প্রদর্শনী কেন্দ্রভিত্তিক গাড়ি বিক্রি অনেক কমে গিয়েছিল। করোনার ভয়ে মানুষ গাড়ি কিনতে আসতে সাহস পাচ্ছিল না। তাই আমরা নিজেদের প্রচারণায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে বেছে নিয়েছিলাম। গ্রাহকদের সাড়াও পাচ্ছি বেশ।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে গাড়ি ক্রেতাদের আগ্রহ নিয়ে মটো সলিউশনের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা নাসিফ আহমেদ খান বলেন, 'সাধারণ ছুটির সময়টিতে প্রদর্শনী কেন্দ্রভিত্তিক গাড়ি বিক্রি অনেক কমে গিয়েছিল। করোনার ভয়ে মানুষ গাড়ি কিনতে আসতে সাহস পাচ্ছিল না। তাই আমরা নিজেদের প্রচারণায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে বেছে নিয়েছিলাম। গ্রাহকদের সাড়াও পাচ্ছি বেশ। পছন্দের গাড়ির ছবি, ভিডিও এবং লাইভ দেখে অনেকেই কেনার ফরমাশ দিয়েছেন। পাশাপাশি অগ্রিম বুকিংয়েও সাড়া মিলেছে।'
২০১৭ সালে ফেসবুকে হাইব্রিড গাড়ি নিয়ে প্রথম লাইভ করেছিলেন মেভেন অটোসের স্বত্বাধিকারী মো. আশফাকুর রহমান। করোনার সময় গাড়ির বিক্রি আগের তুলনায় ৫ শতাংশে নেমে এসেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'ফেসবুক বা ইউটিউব ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। একজন ক্রেতা গাড়ি কেনার আগে পছন্দের সেই গাড়িটি সম্পর্কে বাংলায় ভিডিও দেখতে পারছেন। আগে ইংরেজি বা অন্য ভাষা ছাড়া বাংলায় গাড়ির রিভিউ বা পর্যালোচনা কম ছিল। আমরা চেষ্টা করছি গ্রাহককে গাড়ি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দিতে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেশি বলেই আমরা ফেসবুকে লাইভ করি। এতে মানুষ গাড়ি-সম্পর্কিত প্রশ্নগুলো আমাদের সরাসরি করতে পারে। খুদে বার্তার মাধ্যমেও অনেকে যোগাযোগ করেন। আমি মনে করি, বিশ্বস্ত বিক্রেতা থেকে গাড়ি কেনা হলে ভালো গাড়ি এবং বিক্রয়োত্তর সেবা—উভয়ই মিলবে। প্রতারণার হাত থেকে মুক্তি পেতে গাড়ি বিক্রেতা সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যক্তিগত বা গাড়ির ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশের মধ্যে রাখতে নির্দেশ দিয়েছে। দেশের গাড়ি ক্রেতাদের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত বা উচ্চ-মধ্যবিত্ত হওয়াতে ঋণের অর্থে গাড়ি কিনতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সুদের হার কম থাকার কারণে ক্রেতারা গাড়ি কিনতে আগ্রহী হচ্ছেন। তবে গাড়ির বাজারে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসা সময়সাপেক্ষ। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে গাড়ির বেচাকেনা না হলে গাড়ি বিক্রেতাদের সামগ্রিক অবস্থা নাজুক হতো বলেও মনে করেন আশফাকুর রহমান।
পছন্দের গাড়ি কেনার আগে একজন ক্রেতা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে গাড়ির খোঁজখবর নিতে পারছেন। প্রয়োজনে ইউটিউবে ভিডিও দেখতে পারছেন। গাড়ি বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে গাড়ির বৃত্তান্ত সংগ্রহ করতে পারছেন। প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ, গাড়ির ফিচারগুলো নিশ্চিত করে রিকন্ডিশন্ড গাড়ির নিলামের তথ্য বা অকশন শিটও দেখে নিতে পারছেন অনলাইনে। গাড়ি কেনার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে গাড়ি বুঝে নেওয়ার জন্য গাড়ির প্রদর্শনীকেন্দ্রে যাওয়াটাই যথেষ্ট। অনেক বিক্রেতা হোম ডেলিভারির সুবিধাও দিচ্ছেন। অনলাইনে গাড়ি বেচাকেনার অন্যতম সুবিধা হলো, এখানে ক্রেতাদের গাড়ি সম্পর্কে সব তথ্য জানার সুযোগ রয়েছে। সাধারণত যাঁদের গাড়ি সম্পর্কে আগ্রহ এবং অভিজ্ঞতা দুটোই রয়েছে, তাঁরাই অনলাইনে গাড়ি কিনতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। আবার গাড়িপ্রেমীরা কেনার সামর্থ্য না থাকলেও প্রিয় গাড়িটির খুঁটিনাটি জেনে নিতে পারছেন।
গাড়ি আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান পাইওনিয়ার কারসের স্বত্বাধিকারী এহসানুর রহমান বলেন, 'কোভিড-১৯-এর প্রভাবে অন্যান্য ব্যবসায়ীর তুলনায় গাড়ি ব্যবসায়ীদের অবস্থা বেশি খারাপ। এ সময় বিক্রি ছিল না বললেই চলে। আমরা অন্যান্য প্রদর্শনীকেন্দ্রে গাড়ি সরবরাহ করি। তাদের অবস্থাও শোচনীয়। অনেকে ব্যবসা পরিবর্তনের কথাও চিন্তা করছেন। গাড়ি বিক্রি ৪০-৫০ শতাংশ কমে গেছে। অনেক গাড়ি বন্দরে অপেক্ষমাণ। বিক্রি না হওয়াতে প্রতিনিয়ত বন্দরের মাশুল গুনতে হচ্ছে। ফলে বাড়ছে গাড়ির দাম। কমছে মুনাফা। অন্যদিকে ক্রেতাদেরও কেনার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যক্তিগত বা গাড়ির ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশের মধ্যে রাখতে নির্দেশ দিয়েছে। দেশের গাড়ি ক্রেতাদের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত বা উচ্চ-মধ্যবিত্ত হওয়াতে ঋণের অর্থে গাড়ি কিনতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সুদের হার কম থাকার কারণে ক্রেতারা গাড়ি কিনতে আগ্রহী হচ্ছেন। তবে গাড়ির বাজারে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসা সময়সাপেক্ষ।
মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে সরকারের 'অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রি ডেভেলপমেন্ট পলিসি-২০২০'-এর খসড়াকেও দায়ী করছেন রিকন্ডিশন্ড গাড়ি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো। খসড়া প্রস্তাবনায় রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি কমিয়ে ছয় বছরের মধ্যে সব ধরনের গাড়ি আমদানি বন্ধের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তা গাড়িশিল্পের জন্য হুমকিস্বরূপ বলে উল্লেখ করে এহসানুর রহমান আরও বলেন, জাপানিজ ডোমেস্টিক মার্কেটের (জেডিএম) জন্য যে গাড়িগুলো তৈরি করা হয়, তার স্থায়িত্ব ভারত বা চীনের ব্র্যান্ড নিউ গাড়ির চেয়ে বেশি। দেশের রাস্তায় ৩০ বছরের পুরোনো জাপানি রিকন্ডিশন্ড গাড়ি নির্বিঘ্নে চলাচল করতে দেখা যায়, যেখানে অনেক দেশের নতুন গাড়ি পাঁচ থেকে সাত বছরের মাথায় বিকল হয়ে পড়ে। রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানি এবং বিক্রির সঙ্গে যে বিশাল জনগোষ্ঠীর চাকরি বা ব্যবসায় জড়িত রয়েছে, আমদানি বন্ধ হলে তাঁরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
দেশে ইন্টারনেট এবং স্মার্টফোন আগের তুলনায় সহজলভ্য হওয়ায় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে। পড়াশোনা, অফিস, বেচাকেনা, বিনোদনসহ সবক্ষেত্রেই অনলাইনকেন্দ্রিক গ্রাহক এবং বিক্রেতা শ্রেণি গড়ে উঠছে। সেই দিন হয়তো বেশি দূরে নয় যখন বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ বেঞ্জ অথবা অওডির মতো বিলাসবহুল গাড়িগুলোও অনলাইনেও বিক্রি হবে। আরেকটু বাড়িয়ে চিন্তা করলে আকাশ বা নৌযান বেচাকেনার কথাও একসময় হয়তো আকাশকুসুম কল্পনা হবে না।