‘এমনে বাঁইচা থাকন যায় না’

বিভিন্ন সময় সাহায্যের কথা বলে কাগজপত্র নেওয়া হলেও বলার মতো কিছু পাননি বলে অভিযোগ হাওয়া বেগমের।

সাভারের রানা প্লাজা ধসে চিরদিনের জন্য সন্তানকে হারিয়েছেন এই মা। ২৪ এপ্রিল এলেই ছুটে আসেন, মনে মনে খুঁজে ফেরেন নাড়িছেঁড়া ধনকে। গতকালও সন্তানের একটি ছবি নিয়ে এসেছিলেন রাহেলা বেগম। ছলছল চোখে দাঁড়িয়ে ছিলেন অনেকক্ষণ
ছবি: সাজিদ হোসেন

হাওয়া বেগম (৪৮) ঢাকা–আরিচা মহাসড়কের সাভার কাঁচাবাজারসংলগ্ন পদচারী–সেতুতে প্রায় প্রতিদিনই ভিক্ষা করতে আসেন। সর্বাত্মক বা কঠোর বিধিনিষেধও বিরত রাখতে পারেনি তাঁকে। কারণ, ভিক্ষা করতে না বসলে খাবার জুটবে না তাঁর, হবে না অসুস্থ স্বামীর ওষুধপত্রের সংস্থান।

তবে হাওয়া বেগমের জীবন এমন ছিল না। ২০১২ সালে কুষ্টিয়ার খোকসা থেকে জীবিকার তাগিদে সাভারে আসেন তিনি। কাজ নেন রানা প্লাজার আটতলায় নিউ ওয়েভ স্টাইল নামের একটি পোশাক কারখানায়। সেখানে হেলপারের কাজ করে টানা ৯ মাস সংসার সামলেছেন এই নারী। যদিও অভাব একেবারে ছিল না, তা নয়। তবে ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে পড়লে আহত হন তিনি। পরবর্তী সময়ে ভিক্ষুকের জীবন বেছে নিতে বাধ্য হন হাওয়া বেগম।

পদচারী–সেতুতে বসেই এসব আক্ষেপের কথা বলছিলেন হাওয়া বেগম। রানা প্লাজা ধসের কথা মনে করিয়ে দিতেই কেঁদে উঠলেন তিনি। বললেন, ‘কোনোরকমে উদ্ধার হইছিলাম। কোমরডা ভাইঙ্গা গেছে। কয়েক দিন চোখে আন্ধার দেখছি। আমার মাইয়াটাও ওইখানে কাজ করত। তারও অবস্থা খারাপ। পরে বিয়া দিয়া দিছি। সে আছে তার মতো। আমি অসুস্থ স্বামীরে নিয়া কানতে কানতে দিন পার করতাছি, এমনে বাঁইচা থাকন যায় না।’

বিভিন্ন সময় সাহায্যের কথা বলে তাঁর কাছ থেকে কাগজপত্র নেওয়া হলেও বলার মতো কিছু পাননি বলে অভিযোগ হাওয়া বেগমের। একই রকম অভিযোগ মাহমুদুল হাসান (৩৫), ইয়ানুর বেগম (৩০), হালিমা বেগম (৪৫) ও সাদ্দাম হোসেনের (৩৫)। তাঁরা সবাই রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় আহত শ্রমিকদের সংগঠন ‘রানা প্লাজা সারভাইভারস অ্যাসোসিয়েশন’-এর সদস্য। গতকাল শনিবার সকালে রানা প্লাজা ধসের আট বছর পূর্তিতে ধসে পড়া রানা প্লাজার সামনে জড়ো হয়েছিলেন তাঁরা। ধসের ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের স্মৃতির উদ্দেশে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর তাঁরা সেখানে সংবাদ সম্মেলন করেন। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ইয়ানুর বেগম।

রানা প্লাজা সারভাইভারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহমুদুল হাসান রানা প্লাজার আটতলার নিউ ওয়েভ স্টাইলে কাজ করতেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ভবন দুর্ঘটনায় মেরুদণ্ডে, পায়ে, বুকে, মাথায় আঘাত পাই আমি। এখন পঙ্গু, নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়, থেরাপি নিতে হয়।’ প্রথম দিকে সামান্য কিছু অনুদান পেলেও ক্ষতিপূরণ পাননি বলে জানান তিনি। মাহমুদুল আরও বলেন, রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের জন্য এখন পর্যন্ত যে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। চিকিৎসার অভাবে যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁদের দায়ভার রাষ্ট্রকে নিতে হবে।

গতকাল সকাল থেকে সাভারে রানা প্লাজা ধসে নিহত শ্রমিকদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন আহত শ্রমিক, নিহত শ্রমিকদের আত্মীয়স্বজন ও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতা–কর্মীরা। ধসে পড়া রানা প্লাজার সামনে নির্মিত অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দেন তাঁরা। বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের নেতা–কর্মীরা ১ হাজার ১৩৮ শ্রমিক নিহতের ঘটনায় ১ হাজার ১৩৮টি গোলাপ দিয়ে তৈরি পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর পর্যায়ক্রমে গার্মেন্টস শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ, ইন্ডাস্ট্রি অল বাংলাদেশ কাউন্সিল, শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ), গার্মেন্টস শ্রমিক সমন্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ সংহতি শ্রমিক ফেডারেশনসহ অন্যান্য সংগঠন নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে ফুলেল শ্রদ্ধা জানায়।

এদিকে সকাল থেকে রানা প্লাজার সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করে রাখা হয়। অস্থায়ী বেদির সামনে কাউকে বেশি সময় অবস্থান করতে দেওয়া হয়নি। শ্রদ্ধা জানানো শেষে বেদির সামনে থেকে লোকজনদের সরিয়ে দেয় পুলিশ। বেলা একটার দিকে পুলিশ সেখান থেকে চলে যায়।