করপোরেট দুনিয়ায় এক বিস্ময়কর প্রত্যাবর্তন

করপোরেট দুনিয়ায় প্রত্যাবর্তনের এমন বিস্ময়কর উদাহরণ আর দুটি আছে কি না সন্দেহ। থাকলেও টাটা গোষ্ঠীর হাতে এয়ার ইন্ডিয়া ৬৮ বছর পর যেভাবে ফিরে এল, এককথায় তা তুলনাহীন। হয়তো ইচ্ছাপূরণের কাহিনিও।

গত শুক্রবার ১৮ হাজার কোটি রুপির বিনিময়ে টাটা গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া হয় রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান পরিবহন সংস্থা ‘এয়ার ইন্ডিয়া’ ও ‘এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস’-এর শতভাগ এবং গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সংস্থা ‘এয়ার ইন্ডিয়া স্যাটস’-এর ৫০ শতাংশ মালিকানা। এই প্রত্যাবর্তন অনেক সম্ভাবনার পাশাপাশি বেশ কিছু প্রশ্নও তুলে দিচ্ছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা ও কার্যকারিতাকেন্দ্রিক। টাটারা পারবে তো এয়ার ইন্ডিয়ার হারানো গরিমা ও সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে? নাকি নিমজ্জিত হবে অনিবার্য স্বখাত সলিলে?

অবিভক্ত ভারতে, ১৯৩২ সালে, ‘টাটা এয়ারলাইনস’ চালু করেছিলেন শিল্পপতি জে আর ডি টাটা। সেই বছরের ১৭ অক্টোবর করাচি থেকে চিঠিপত্র নিয়ে বোম্বে হয়ে মাদ্রাজ উড়ে গিয়েছিলেন জে আর ডি টাটা স্বয়ং। সেই ঘটনার ছয় বছরের মধ্যেই আকাশে ওড়ে টাটা এয়ারলাইনসের প্রথম যাত্রীবাহী বিমান। তার কয়েক বছরের মধ্যেই নামবদল। টাটা এয়ারলাইনস হয়ে যায় ‘এয়ার ইন্ডিয়া’। মালিকানা পুরোটাই থাকে টাটাদের হাতে।

সে ছিল স্বাধীনতা-পূর্বের ভারত। ব্রিটিশমুক্ত স্বাধীন ভারত ১৯৪৮ সালে এয়ার ইন্ডিয়ার ৪৯ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়। সেই বছরেই প্রথম আন্তর্জাতিক উড়াল। বোম্বে টু লন্ডন। এর পাঁচ বছর পর, ১৯৫৩ সালে, জওহরলাল নেহরুর সরকার এয়ার ইন্ডিয়া রাষ্ট্রীয়করণের সিদ্ধান্ত নেন নাটকীয়ভাবে। তখন ভারতের যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন জগজীবন রাম। জে আর ডি টাটাকে তিনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন। রুশি মোদিকে সঙ্গে নিয়ে জগজীবন রামের সঙ্গে দেখা করতে গেলে টাটার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। তাঁকে জানানো হয়েছিল, সরকার এয়ার ইন্ডিয়া অধিগ্রহণ করে নিচ্ছে।

জগজীবন রামকে ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত জে আর ডি টাটা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি কি মনে করেন যেভাবে আপনারা সরকারি মন্ত্রণালয় চালান, সেইভাবে বিমান পরিবহন চালাতে পারবেন? পারবেন না। নিজেই সেটা দেখতে পারবেন।’ জগজীবন রাম ঠান্ডাভাবে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এটা সরকারি সিদ্ধান্ত। তবে সরকারি সংস্থা হলেও এয়ার ইন্ডিয়া চালাতে আমরা আপনার সাহায্য নেব।’ সেই দিনের সেই বৈঠক অসমাপ্ত রেখে টাটা ফিরে গিয়েছিলেন। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে এক সাক্ষাৎকারে সরকারের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে টাটা বলেছিলেন, ‘কোনো কিছুরই রাষ্ট্রীয়করণ দেশের জন্য মঙ্গলের হতে পারে না। কারণ, সংস্থা চালাবেন আমলারা। যেকোনো সিদ্ধান্তের জন্য তাঁরা তাকিয়ে থাকবেন রাজনৈতিক প্রভুর দিকে। ফলে ঠিক সময়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত কিছুতেই নেওয়া যাবে না।’ সাক্ষাৎকারের এক প্রতিলিপি নেহরুকেও পাঠিয়েছিলেন টাটা এই আশায় যে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী পিছিয়ে আসবেন। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা।

শেষমেশ আরও একটা চেষ্টা টাটা করেছিলেন। নেহরুকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উড়াল বিচ্ছিন্ন করে দুটি সংস্থা তৈরি করা হোক। দেশীয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত করা হোক, আন্তর্জাতিক সংস্থা থাকুক তাঁর হাতে, যাতে দেশের সম্মানটুকু অন্তত বজায় রাখা যায়। নেহরু সেই যুক্তিও মানেননি। তবে টাটাকে তিনি চেয়ারম্যান হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। জে আর ডি টাটা তা মেনেও নিয়েছিলেন। সেই যোগসূত্রও অবিশ্বাস্যভাবে ছিন্ন হয় ১৯৭৮ সালে। ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেসকে পরাস্ত করে আগের বছর প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন মোরারজি দেশাই। নেহরুর মতো শালীনতার ধার তিনি ধারেননি। জগজীবন রাম তাঁর দপ্তরে টাটাকে ডেকে পাঠিয়ে সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন, মোরারজি দেশাই চেয়ারম্যান পদ থেকে টাটাকে বরখাস্ত করার কথা জানিয়েছিলেন চিঠি লিখে। সেই পদে বসানো হয়েছিল অবসরপ্রাপ্ত এয়ার চিফ মার্শাল প্রতাপ চন্দ্র লালকে।

এয়ার ইন্ডিয়ার অবক্ষয় শুরু আশির দশক থেকে। কেন্দ্রীয় সরকার যত দুর্বল হয়েছে, ততই বেড়ে গেছে এয়ার ইন্ডিয়ার লোকসানের বহর। একটা সময় এমন অবস্থা হয়েছিল যে আমলারা কেউ দায়িত্বই নিতে চাইছিলেন না। উদার অর্থনীতির সরণি ধরে বেসরকারি বিমান পরিবহনব্যবস্থা চালু হওয়ার পর এয়ার ইন্ডিয়ার হাল আরও খারাপ হয়ে যায়। ২০০৭ সালে সরকার এয়ার ইন্ডিয়া ও ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসকে মিলিয়ে একটি সংস্থা করে, যাতে লোকসান কমে। অসামরিক বিমান পরিবহনমন্ত্রী অজিত সিং ৩০ হাজার কোটি রুপির জোগানও দেন রুগ্‌ণতা সারাতে। কিন্তু লাভ তো দূরের কথা, ২০১৭ সালে দেনার বহর ৫২ হাজার কোটি রুপি পেরিয়ে যায়, যা কিনা দেশের ১০০ দিনের কাজের মোট বাজেটের চেয়েও বেশি। আজ, ২০২১ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত এয়ার ইন্ডিয়ার মোট ঋণ প্রায় ৬২ হাজার কোটি রুপি। দৈনন্দিন লোকসানের পরিমাণ ২০ কোটি। বার্ষিক ৭ হাজার ৩০০ কোটির ধাক্কা।

এয়ার ইন্ডিয়ার বিলগ্নীকরণের চেষ্টা চলছিল ২০ বছর ধরে। ২০০১ সালে সরকার ৪০ শতাংশ শেয়ার বেচতে চেয়েছিল। পারেনি। ২০১৮ সালে ৭৬ শতাংশ বিলগ্নীকরণের চেষ্টাও বাতিল হয় ক্রেতা না মেলায়। সরকারের সামান্য অংশীদারত্বও যে বিক্রির পথে প্রধান বাধা, অবশেষে সেই উপলব্ধিই কাজ হাসিল করে। টাটারা সবার চেয়ে বেশি দরপত্র দিয়ে হারানো নিধি ঘরে তুলেছে।

টাটাদের কাছে এটা ঘরের ছেলের ঘরে ফেরার কাহিনি। অথবা হারানো নিধি ফিরে পাওয়ার গল্প। সেই কাহিনিতে মিশে রয়েছে ‘নস্টালজিয়া ও পোয়েটিক জাস্টিস’। যে ভারত সরকার একদা এয়ার ইন্ডিয়া জবরদস্তির মাধ্যমে কেড়ে নিয়েছিল, সেই সরকারই এখন তা ফেরত দিয়ে জে আর ডি টাটার বক্তব্যকেই অমোঘ প্রতিপন্ন করল। টাটাদের পক্ষে অবশ্যই এ এক মধুর জয়।

সেই জয়ে বাণিজ্যিক দূরদৃষ্টি কতটা আর কতটাই-বা আবেগ, সময় সেই উত্তর দেবে। সরকারের লাভ এটুকুই, বছরের পর বছর তাদের ঘাটতি মেটাতে করের টাকা বরাদ্দ করতে হবে না। টাটার লাভ, ৬১ হাজার ৫৬২ কোটি রুপির মোট ঋণের মধ্যে তারা নিচ্ছে মাত্র ১৫ হাজার ৩০০ কোটির দায়। এ ছাড়া সরকারকে নগদ দিতে হচ্ছে ২ হাজার ৭০০ কোটি। এর অর্থ সরকারের ঘাড়ে ঋণ থাকছে ৪৩ হাজার ৫৬২ কোটির। সংস্থার সম্পদ, যেমন জমি-বাড়ি বেচে সরকারের ঘরে ঢুকতে পারে ১৪ হাজার ৭১৮ কোটি রুপি। তার মানে ২৮ হাজার ৮৪৪ কোটি ঋণ সরকারকে মেটাতে হবে।

সন্দেহ নেই, টাটা বিরাট এক ঝুঁকি নিয়েছে। চ্যালেঞ্জও। নিজের কাছে নিজেকে প্রমাণ করার। কাজটা নিঃসন্দেহে কঠিন। কারণ, ২০২১ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত ভারতের আকাশবাণিজ্যের ৫৯ দশমিক ৬ শতাংশের মালিকানা ‘ইন্ডিগো’র। এয়ার ইন্ডিয়ার স্থান দ্বিতীয় হলেও বহু দূরে তার অবস্থান। ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ। তৃতীয় স্থানে ‘স্পাইসজেট’। মার্কেট শেয়ার ৯ দশমিক ১ শতাংশ। টাটাদের অন্য দুই এয়ারলাইনস ‘ভিস্তারা’ ও ‘এয়ার এশিয়া’র মার্কেট শেয়ার যথাক্রমে ৮ দশমিক ১ ও ৩ দশমিক ৩ শতাংশ! প্রত্যাবর্তন ও অর্জনের এই কাহিনিকে সফল করতে রতন টাটা ও তার সহযোগীদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে।

আবেগের সঙ্গে বাস্তবতার মেলবন্ধন কদাচিৎ ঘটে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে ‘ন্যানো’ তৈরির সিদ্ধান্তের পেছনে আবেগ যে বেশি কাজ করেছিল, বহু দিন পর রতন টাটা নিজেই সে কথা স্বীকার করেছিলেন। গুজরাটেও ‘ন্যানো’ গুটিয়ে গেছে। টাটাদের ঝলমলে মুকুটে সেটা এক ব্যর্থতার পালক। এয়ার ইন্ডিয়া ফিরে পাওয়াও যে আবেগমিশ্রিত, রতন টাটার টুইটেই তা প্রমাণিত। তিনি লিখেছেন, ‘ওয়েলকাম ব্যাক এয়ার ইন্ডিয়া। এই নিলাম জয় দুর্দান্ত। জে আর ডি টাটা আজ আমাদের মধ্যে থাকলে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন।’ আবেগ কাটিয়ে এয়ার ইন্ডিয়ার সুদিন ফেরাতে পারলে অবশ্যই সেটা হবে প্রত্যাবর্তনের সফলতম উপাখ্যান। অর্থনীতির পণ্ডিতদের ভুল প্রমাণ করে দেখানো যাবে, এয়ার ইন্ডিয়া মহাশূন্যের কৃষ্ণগহ্বর নয়।