করব্যবস্থা পাল্টান, নইলে বর্তমান ব্যবসা থাকবে না

বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যানও স্বীকার করেন, করপোরেট করে ভারসাম্য আনা না হলে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা যাবে না।

করোনার এই সংকটে বিশ্বব্যাপী সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআইয়ের গতি শ্লথ হয়ে গেছে। তারপরও বাংলাদেশের সামনে নতুন সুযোগ আছে। তবে দেশের বর্তমান করব্যবস্থা ব্যবসাবান্ধব নয়। এই করব্যবস্থায় এফডিআই আসবে না। করব্যবস্থায় সংস্কার আনার পাশাপাশি বিনিয়োগ আকর্ষণে সুনির্দিষ্ট দেশ, খাত ও কোম্পানিকে লক্ষ্য করে এগোতে হবে।

‘পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য ও উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার যাত্রাকে মসৃণ করার জন্য এফডিআই’ শীর্ষক অনলাইন আলোচনা সভায় গতকাল শনিবার ব্যবসায়ী নেতারা এসব কথা বলেন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। অর্থনৈতিক বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ), বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (আরএপিআইডি) এবং এশিয়া ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে আলোচনা সভাটি হয়। এতে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন আরএপিআইডির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক।

প্রতিযোগী অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এফডিআই অনেক কম বলে উল্লেখ করেন মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। একই সময়ে কম্বোডিয়ায় ৩ হাজার ৪০০ এবং ভিয়েতনামে ১৬ হাজার ১০০ কোটি ডলারের এফডিআই এসেছে। বাংলাদেশে বার্ষিক এফডিআই প্রবাহ জিডিপির মাত্র ১ শতাংশের মতো হলেও ভিয়েতনামে সেটি ৬ শতাংশের কাছাকাছি।

সবকিছু ঠিক থাকলে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে যাবে বাংলাদেশ। এরপর শুধু উন্নয়শীল দেশ হলে বিনিয়োগকারীদের কর অবকাশ-সুবিধা দেওয়া যাবে না। বিভিন্ন বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধাও থাকবে না। তাই দ্রুত তথ্যপ্রযুক্তি, সেবা, ওষুধশিল্পের মতো সম্ভাবনাময় খাতে এফডিআই বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দেন আরএপিআইডির চেয়ারম্যান।

বাংলাদেশের করব্যবস্থা ব্যবসাবান্ধব নয় বলে মন্তব্য করেন অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের করব্যবস্থা চূড়ান্তভাবে ব্যবসা বৈরী। এ কারণে ব্যবসা বন্ধ করেই দেওয়া উচিত। আমরা যারা বাংলাদেশে ব্যবসা করি, আমরা কাল থেকে কান ধরে ছেড়ে দিতে চাই। লাভ হোক আর লোকসান, যা-ই হবে কর দিয়েই যাবেন। যারা কর দেয় না, তারাই ভালো থাকবে। তারা আরও বড় বড় ব্যবসা করবে আর আমরা মরব। এই ধরনের ব্যবসার মধ্যে আর আমরা নাই। করব্যবস্থা ঠিক করেন। অন্যথায় বর্তমান ব্যবসাই থাকবে না, নতুন বিনিয়োগের তো প্রশ্নই ওঠে না।’

পণ্য রপ্তানি বাড়াতে বিদেশি বিনিয়োগের ওপর জোর দিয়ে সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ভিয়েতনামের শীর্ষ পাঁচটি জুতা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান দেশি-বিদেশি যৌথ বিনিয়োগ। ভিয়েতনামে যৌথ বিনিয়োগে স্থাপিত একটি কোরিয়ান কোম্পানি ১০০ কোটি ডলারের জুতা রপ্তানি করে। আর আমরা সবাই মিলে সেই পরিমাণ জুতা রপ্তানি করছি। এটিই আসলে এফডিআইয়ের মূল শক্তি।

দেশের ব্যবসায়ীরা যথাযথ সম্মান পান না বলে অভিযোগ করেন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি নিহাদ কবির। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি হিসেবে উল্লেখ করেন। অথচ একজন উপসচিব তাঁর টেবিলের সামনে আমাকে বলেছেন, আপনারা ব্যবসায়ীরা মানুষজনকে ঠকানোর কাজ করেন। আসলে বাংলাদেশে ব্যবসায়ীদের যেভাবে মূল্যায়ন করা হয়, সেভাবে চোরদেরও হয়তো মূল্যায়ন করা হয় না। দেশের ব্যবসায়ীদের সম্মানের সঙ্গে মূল্যায়ন না করলে বিদেশি ব্যবসায়ীরাও আসবে না।’

বাংলাদেশের করব্যবস্থা চূড়ান্তভাবে ব্যবসা বৈরী। এ কারণে ব্যবসা বন্ধ করেই দেওয়া উচিত। আমরা যারা বাংলাদেশে ব্যবসা করি, আমরা কাল থেকে কান ধরে ছেড়ে দিতে চাই।
সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার

নিহাদ কবির আরও বলেন, ‘সিঙ্গাপুর বছরের পর বছর হাত জোড় করে অনুরোধ করে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিজেদের দেশে আনার পরই প্রবৃদ্ধির দেখা পেয়েছে। আমরা সেটি করছি না। আমরা সুন্দর পসরা সাজিয়ে বসে আছি। কেন তারা (বিদেশি বিনিয়োগ) আমাদের দেশে আসছে না, সেটি কিন্তু আমরা একবারও জিজ্ঞেস করি না।’

শেয়ারবাজার ও আবাসন খাতে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার সমালোচনা করে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, ‘কর ফাঁকি দিলে আমার ২২ শতাংশ অর্থ বেঁচে যাবে। কারণ, ১০ শতাংশ কর দিয়েই আমি কালোটাকা সাদা করতে পারব। শেয়ারবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ থাকায় বাবল ইকোনমি তৈরি হবে, যা একদিন বিস্ফোরণ ঘটবে।’ স্বাস্থ্য খাতে কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ব্যবসায়িক বিরোধ নিষ্পত্তিতে ঢাকা ও চট্টগ্রামে আলাদা আদালত হবে। সেই আদালতকে ক্ষমতাও দেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘করপোরেট কর অনেক বেশি হওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগ আসতে চায় না। আমাদের এই জায়গায় ভারসাম্য আনতে হবে। না হলে তাদের আকৃষ্ট করা যাবে না।’

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেন, ‘সংস্কার নিয়ে বেশি কথা বলব না। বহির্বিশ্বে আমাদের পরিচিতি কী? আসলে আমরা সাইড লাইনে রয়েছি। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে আপনাদের কাজ করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের ভোটের চিন্তা আছে। আপনাদের ভোটের চিন্তা নেই। কিন্তু আপনারা অনেক বেশি পেছনগামী হন।’

ইআরএফের সহসভাপতি এম শফিকুল আলমের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন এশিয়া ফাউন্ডেশনের এ দেশীয় পরিচালক কাজী ফয়সাল বিন সিরাজ, আরএপিআইডির নির্বাহী পরিচালক এম আবু ইউসুফ প্রমুখ। সঞ্চালনা করেন ইআরএফের সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম।