করোনায় তরুণদের ২৫% বেকার

করোনা নিয়ে আইএলওর প্রতিবেদন

  • অন্তত ১৭ লাখ বেকার হয়েছেন

  • কৃষি ও বস্ত্র খাতে বেশি বেকার

  • এশিয়ার ১৩টি দেশে দেড় কোটি তরুণ কর্মহীন

  • তরুণ বেকারত্ব ১২% থেকে বেড়ে ২৫%

  • অনলাইন পোর্টালে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি কমেছে

প্রতীকী ছবি

করোনার আগে ফেরদৌস ইফতেখার উত্তরার একটি প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন দুই ব্যাচে ৪০ জন চাকরি প্রত্যাশীকে তথ্যপ্রযুক্তির দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ দিতেন। ৩০ বছর বয়সী ফেরদৌস ইফতেখারের চারজনের ছোট সংসার। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে এপ্রিলের শুরুতে সব ধরনের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়, চাকরি হারান ফেরদৌস। করোনাকাল শেষ হয় না, তাঁর বেকার জীবনও কাটছে না। ব্যবসায় বাণিজ্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ফেরদৌস ইফতেখার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কবে করোনা পরিস্থিতি ঠিক হবে, জানি না। সংসার চালাতে এখন টুকটাক ব্যবসার চিন্তাভাবনা করছি।’

করোনার কারণে ফেরদৌসের মতো দেশের লাখ লাখ তরুণ-তরুণী বেকার হয়ে গেছেন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনায় বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্বিগুণ হয়েছে। করোনার আগে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে প্রতি ১০০ জনে গড়ে ১২ জন বেকার ছিলেন। এখন তা বেড়ে প্রায় ২৫ জন হয়েছে। এর মানে, প্রতি চারজন কাজপ্রত্যাশী তরুণের মধ্যে একজন বেকার।

বর্তমানে নতুন চাকরির সুযোগ বেশ সীমিত। করোনায় বেকার হয়ে যাওয়া তরুণ-তরুণীদের পাশাপাশি বিপাকে পড়েছেন নতুন চাকরিপ্রত্যাশীরাও। পুরোনো ২৭ লাখ বেকার তো আছেনই। ব্যবসা-বাণিজ্যে টান পড়ায় ছোট-বড় কোম্পানিগুলো আগের মতো নতুন জনবল নিয়োগ দিতে আগ্রহী হচ্ছে না।

তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব দ্বিগুণ হয়েছে

করোনা মহামারির কারণে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের তরুণ-তরুণীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়েছেন। তাঁদের মধ্যেই বেকার হওয়ার প্রবণতা বেশি। সব ব্যবসা-বাণিজ্য তথা অর্থনীতির গতি কমায় কত তরুণ-তরুণী কাজ হারিয়েছেন—আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক প্রতিবেদনে তা উঠে এসেছে। ‘এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশে তরুণদের কর্মসংস্থান সংকট মোকাবিলা’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি গত আগস্ট মাসে প্রকাশিত হয়েছে। আইএলওর এই প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।

আইএলওর প্রতিবেদনে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৩টি দেশে করোনায় চাকরি হারানোর চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ওই সব দেশের মধ্যে বাংলাদেশ আছে। ওই তালিকায় আরও আছে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, কম্বোডিয়া, ফিজি, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মঙ্গোলিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম।

করোনার কারণে চাকরির সুযোগ কমেছে। আইএলও বলেছে, করোনায় বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।

করোনার কারণে কত তরুণ বেকার হলেন, তার হিসাব করতে গিয়ে দুটি প্রেক্ষাপট বিবেচনা করেছে আইএলও। একটি হলো করোনার প্রাদুর্ভাব তিন মাস থাকলে কত বেকার হয়েছে, ছয় মাস হলে চিত্রটি কেমন হবে, তা দেখানো হয়েছে। তবে তালিকায় থাকা বেশির ভাগ দেশেই করোনার প্রাদুর্ভাব ছয় মাস ধরে চলছে। আইএলও বাংলাদেশ সম্পর্কে বলেছে, করোনা সংকট ছয় মাস প্রলম্বিত হওয়ায় বাংলাদেশের কাজপ্রত্যাশী তরুণদের মধ্যে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশই বেকার হয়ে গেছেন। ২০১৯ সালের হিসাবে তা ছিল ১১ দশমিক ৯ শতাংশ। করোনার কারণে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্বিগুণ হয়েছে।

কত তরুণ বেকার হয়েছেন, তাও প্রাক্কলন করেছে আইএলও। সাধারণত তরুণেরা পূর্ণ ও খণ্ডকালীন কাজ করেন। করোনায় উভয় শ্রেণির তরুণেরাই কাজ হারিয়েছেন। আইএলও বলছে, সবাই যদি পূর্ণকালীন কাজ করতেন অর্থাৎ সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা কাজ করতেন, তাহলে মোট বেকারের সংখ্যা দাঁড়াত ১৬ লাখ ৭৫ হাজার। এর মানে, বাস্তবে বাংলাদেশে আরও বেশি তরুণ বেকার হয়েছেন।

আইএলও আরও বলেছে, প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি ছাঁটাই হয়েছে। তরুণদের ছাঁটাই করা তুলনামূলক সহজ। আবার কর্মীদের কর্মঘণ্টা কমানো হয়েছে। অনেকে আনুষ্ঠানিক খাত থেকে অনানুষ্ঠানিক খাতে চলে গেছেন। তাই প্রকৃত অর্থে কত তরুণ বেকার হয়েছেন, তা নির্ধারণ করা কঠিন। করোনায় তরুণদের চাকরি বেশি গেছে। একটি দেশের উৎপাদন ও শ্রমের চাহিদার ভিত্তিতে বেকারের হিসাবটি করা হয়েছে।

করোনার প্রাদুর্ভাব ছয় মাস অতিক্রম করায় সব মিলিয়ে ওই ১৩টি দেশে ১ কোটি ৪৮ লাখ তরুণ কাজ হারিয়েছেন বলে মনে করছে আইএলও। ভারতে সবচেয়ে বেশি, ৬১ লাখের বেশি তরুণ বেকার হয়ে গেছেন।

আইএলওর হিসাবে ৩৫টি খাতের মধ্যে সাতটি খাতে বেশি কাজ হারিয়েছেন তরুণেরা। এই খাতগুলো হলো কৃষি, খুচরা বিক্রি, হোটেল-রেস্তোরাঁ, অভ্যন্তরীণ পরিবহন, বস্ত্র, নির্মাণ ও অন্যান্য। বাংলাদেশে যত তরুণ-তরুণী কাজ হারিয়েছেন, তাঁদের প্রায় ৭৬ শতাংশ এই সাত খাতের। এর মধ্যে কৃষি খাতে ২২ দশমিক ৯ শতাংশ এবং বস্ত্র খাতে খাতে ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, করোনার প্রথম দুই-তিন মাস বেকারের সংখ্যা বেড়েছে। প্রথম দিকে কঠোর বিধিনিষেধ দেওয়া হলেও পরে শিথিল করা হয়েছে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সার্বিক অর্থনীতি অর্থনীতি সচল হতে শুরু করে। এতে বিপুলসংখ্যক মানুষের বেকার হওয়া ঠেকানো সম্ভব হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

চাকরির সুযোগ কমেছে

দেশে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক, এ দুই খাতেই কর্মসংস্থান হয়। অনানুষ্ঠানিক খাতের নিয়োগ দিতে কোনো বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় না। আনুষ্ঠানিক খাতে পত্রপত্রিকা, অনলাইন পোর্টাল কিংবা নিজস্ব ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন দিয়ে সাধারণত নিয়োগ দেওয়া হয়। করোনাকালে নতুন চাকরির বিজ্ঞাপন দেওয়া অনেক কমেছে।

একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। চাকরির খবরাখবরের জন্য বিডিজবস বাংলাদেশের বৃহত্তর অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। করোনার কারণে এই অনলাইন প্ল্যাটফর্মে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ব্যাপক কমেছে। গতকাল রোববার বিকেল পর্যন্ত বিডিজবসে বিভিন্ন কোম্পানির ২ হাজার ৭৬৮টি চাকরির বিজ্ঞাপন পাওয়া গেছে। করোনার আগে স্বাভাবিক সময়ে সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার চাকরির বিজ্ঞাপন থাকত।

বিডিজবস সূত্রে জানা গেছে, গত এপ্রিল মাসে মার্চের তুলনায় ৮০ শতাংশ চাকরির বিজ্ঞাপন কমেছে। মে মাসে কমেছে ৭০ শতাংশ। জুন-জুলাই মাসে এ পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করে। তবে এখনো চাকরির বিজ্ঞাপনের প্রবাহ আগের জায়গায় ফিরে আসেনি। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে এখনো ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কম চাকরির বিজ্ঞাপন আসছে। বিডিজবসের চাকরির খবরগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেই অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোক খোঁজা হচ্ছে। একদম নতুন চাকরিপ্রত্যাশীদের চাকরির খবর তেমন একটা নেই।

ভারী শিল্পে দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী বিএসআরএম। করোনার কারণে বিএসআরএমের ইস্পাত খাতের তিনটি প্রকল্পের কাজের গতি কমে গেছে। এর মধ্যে একটি নতুন ও দুটি সম্প্রসারণমুখী কারখানা। মূলত বিদেশিদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকায় প্রকৌশলীরা আসতে পারছেন না। তাই যন্ত্রপাতি স্থাপনের কাজ আটকে গেছে। কাজও শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না।

বিএসআরএমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমেরআলী হুসেইন এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, করোনা না হলে এত দিনে কাজ প্রায় শেষের দিকে থাকত। করোনার কারণে সব কাজ শ্লথ হয়ে গেছে। করোনা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে আরও ছয়-সাত মাস লাগবে। ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক না হলে উদ্যোক্তারা নিজেদের ব্যবসা সম্প্রসারণে যাবেন না। নতুন জনবল নিয়োগ দেওয়াও কঠিন। চাকরিপ্রত্যাশীদের সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘একজন স্নাতক বেকার হয়ে বসে থাকার কষ্ট আমরা বুঝি। তাঁদের ওপর সামাজিক চাপও তৈরি হয়। একটু ধৈর্য ধরতে হবে। আমার পরামর্শ হলো, পছন্দমতো কাজ না পেলেও তাঁরা মোটামুটি মানসম্পন্ন চাকরি পেলেও যেন যোগ দেন।’

নতুন চাকরিপ্রত্যাশীদের কী হবে

পরিকল্পনা কমিশনের হিসাবে, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১৮ লাখ তরুণ-তরুণী শ্রমবাজারে আসেন। এর মধ্যে ছয় থেকে সাত লাখ বিদেশে যান। বাকি ১১ থেকে ১২ লাখ লোকের অভ্যন্তরীণ বা দেশেই কর্মসংস্থান হয়। করোনার কারণে বিদেশ থেকে শ্রমিকেরা ফিরে আসছেন। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতেও মন্দাভাব। সেখানেও প্রবাসী শ্রমিকদের চাকরির সুযোগ কমে গেছে।

শ্রমবাজারে ২৯ বছরের কম বয়সী তরুণ-তরুণীদের অংশগ্রহণ যেমন বেশি, তেমনি তাঁদের মধ্যেই বেকার বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ (২০১৬-১৭) অনুযায়ী, দেশের শ্রমশক্তিতে ৬ কোটি ৩৫ লাখ লোক আছেন। এর মধ্যে ১৫ থেকে ২৯ বয়সী তরুণ-তরুণীর সংখ্যা ২ কোটি ৮৩ হাজার। তাঁদের মধ্যে কর্মজীবী ১ কোটি ৭৯ লাখ। দেশে ওই সময়ে বেকার ছিল ২৭ লাখ। ওই বেকারদের মধ্যে ২২ লাখের বয়স ২৯ বছরের কম। করোনার কারণে তরুণ বেকারের সংখ্যা নিঃসন্দেহে আরও বেড়েছে। ফলে নতুন চাকরিপ্রত্যাশী শ্রমশক্তিতে যুক্ত হওয়ার পর বেকারের সংখ্যা আরও বাড়বে।

পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য শামসুল আলমের মতে, নতুন চাকরিপ্রত্যাশীদের কর্মসংস্থানের জন্য প্রথমেই অর্থনীতিকে চাঙা রাখতে হবে। দ্রুত ব্যবসা-বাণিজ্য আগের অবস্থায় আনতে হবে। বিনিয়োগ বাড়লে নতুন নতুন কলকারখানা হবে, কাজের সুযোগ বাড়বে।