কর্মকর্তাদের পরিদর্শন ক্ষমতায় লাগাম টানল কেন্দ্রীয় ব্যাংক

বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে ঋণ অপব্যবহারের চিত্র পেলেও তা আর শ্রেণীকৃত (খেলাপি) করতে পারবে না। সংশ্লিষ্ট ঋণ খেলাপি করতে হলে তদারকি বিভাগের ডেপুটি গভর্নরকে অবহিত করতে হবে। এরপরই ওই ঋণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকে এত দিন পরিদর্শন কর্মকর্তারাই ঋণ শ্রেণীকৃত করতে পারতেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন নীতিমালায় এ বিষয়টি সংযোজন করেছেন ডেপুটি গভর্নর এস এম মনিরুজ্জামান। গত ২৪ জুলাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শকদের জন্য নতুন এ নিয়ম অনুমোদন করেন তিনি। এরপরই ব্যাংক পরিদর্শনের সঙ্গে যুক্ত সব বিভাগকে বিষয়টি পালনের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ-২-এর উপমহাব্যবস্থাপক খোয়াজ সিকদার স্বাক্ষরিত এক চিঠির মাধ্যমে বিষয়টি সবাইকে জানানো হয়েছে।
নতুন এ নিয়ম চালুর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি কার্যক্রম অনেকটাই থমকে গেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণের অনিয়ম যে হারে বেড়েছে, সে হারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন কার্যক্রম বা তদারকি বাড়েনি। এখন ঋণ অপব্যবহারের তথ্য পাওয়ার পর সেগুলো শ্রেণীকৃত করতে ডেপুটি গভর্নরের সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তাহলে পরিদর্শন কার্যক্রম চলবে না। ডেপুটি গভর্নরের একার পক্ষে সারা দেশের ১০ হাজার শাখার ঋণের তদারকি করাও সম্ভব নয়। ফলে অনিয়ম আরও বেড়ে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ তাঁর মেয়াদকালে পরিদর্শন কার্যক্রম দেখভাল করতেন। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেসব কর্মকর্তা সরেজমিন পরিদর্শন করবেন, তাঁদের কাছেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকা উচিত। কারণ, তাঁদের থেকে পরিস্থিতি কেউ ভালো বুঝবেন না। প্রয়োজনে সিদ্ধান্তের সারমর্ম জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা জানতে পারেন। যদি আইনি সমস্যার কথা বলে এ পরিবর্তন আনা হয়, তাহলে এত দিন কীভাবে চলল। এসব অহেতুক কথাবার্তা।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিচালিত হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ১৯৭২ অনুযায়ী। এতে উল্লেখ রয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রম মূলত ছয়টি। এর মধ্যে শেষেরটি হলো, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিচালনা ও তদারকি করা।
মূলত নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে পরিচালনার সহায়তা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। নীতি অনুযায়ী ব্যাংকগুলো পরিচালিত হচ্ছে কি না, তা তদারকি করে। পাশাপাশি যে ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে, তা যথাযথ কাজে ও নিয়ম মেনে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না, তা-ও তদারকি করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব।
দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত, বিশেষায়িত ও বেসরকারি যেসব ব্যাংক রয়েছে, সেগুলোর তদারকি করে বাংলাদেশ ব্যাংকের অফ সাইট সুপারভিশন বিভাগ। আর ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম ও ঋণের বিষয়ে তদারকি করতে রয়েছে পৃথক চারটি ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ। এ ছাড়া তাৎক্ষণিক ও অভিযোগের বিষয়ে ঝটিকা পরিদর্শন করে ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার সার্ভিসেস বিভাগ। এ ছাড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শনেও রয়েছে পৃথক বিভাগ।
পরিদর্শনের সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা কী নীতিমালা মেনে চলবেন, তা উল্লেখ আছে অন সাইট সুপারভিশন নীতিমালায়। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে সর্বশেষ এই নীতিমালা সংশোধন হয়েছে। ওই সময়ে তদারকি বিভাগগুলোর দায়িত্বে থাকা ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান তা অনুমোদন দেন। এর চ্যাপটার ৪-এ উল্লেখ রয়েছে, পরিদর্শনের সময় ঋণের ব্যবহার, প্রকল্পের অস্তিত্ব, মূল্য পরীক্ষা করতে হবে। এ ছাড়া ঋণের জামানত ও নথিপত্রও দেখতে হবে।
এ নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংক শাখা পরিদর্শনের সময় কোনো বিশেষ ঋণের বিষয়ে সন্দেহ হলে বা অপব্যবহারের তথ্য থাকলে সংশ্লিষ্ট পরিদর্শক নথিপত্র সংগ্রহ করে থাকেন। এরপর প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমতি নিয়ে প্রকল্পও পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনে ঋণ অপব্যবহারের তথ্য মিললে বিভিন্ন মানে শ্রেণীকৃত করা হয়।
গত ২৪ জুলাই নীতিমালায় নতুন করে তিনটি বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, পরিদর্শন চলাকালে কোনো ঋণ হিসাব গুণগত মানের ভিত্তিতে বিরূপভাবে শ্রেণীকরণের (খেলাপি) বিষয়ে কমপক্ষে বিভাগের মহাব্যবস্থাপকের অনুমোদন নিতে হবে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট নির্বাহী পরিচালক ও ডেপুটি গভর্নরকে অবহিত করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো শাখা অফিস এমন কার্যক্রম চালালে প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন নিতে হবে। এ ছাড়া কোনো ব্যাংক পরিদর্শকদলের আপত্তির বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ডেপুটি গভর্নর পর্যন্ত অনুমোদন নিতে হবে। ঋণের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে কি না, তা পরিদর্শন করতে ডেপুটি গভর্নর পর্যন্ত অবহিত করতে হবে।
গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে ধরা পড়া অনিয়মগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো হল-মার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, আনন্দ শিপইয়ার্ড কেলেঙ্কারি, বেসিক, ফারমার্স ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের অনিয়ম। এই ছয়টি পরিদর্শনের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কয়েক দফায় কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেসব কর্মকর্তা বলেন, নতুন নিয়মের ফলে গতি হারিয়ে ফেলবে পরিদর্শন কার্যক্রম। কর্মকর্তাদের স্বাধীনতা না দিলে ভালো প্রতিবেদন পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
পরিদর্শনে ধরা পড়া অনিয়মের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে দেশের ১৪টি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যেসব ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসানো হয়েছে সেগুলো হলো সরকারি খাতের সোনালী, রূপালী, অগ্রণী, জনতা, বেসিক, বিডিবিএল ও কৃষি। আর বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল, ইসলামী, এবি, আইসিবি ইসলামিক, বাংলাদেশ কমার্স, ফারমার্স ও এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক। এর বাইরে পিপলস লিজিং, বিআইএফসি ও ফার্স্ট ফিন্যান্স—এই তিন আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও পর্যবেক্ষক বসানো হয়েছে।
এদিকে পরিদর্শনের ক্ষেত্রে নতুন নিয়ম চালুর বিষয়ে ডেপুটি গভর্নর এস এম মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘তদারকি বিভাগগুলোর প্রধান হিসাবে কোন ঋণ শ্রেণীকৃত করা হচ্ছে, তা আমাকে জানতে হবে। কারণ, এসব ঋণ শ্রেণীকৃত করার ফলে বড় ধরনের আইনি সমস্যা হচ্ছে। এ কারণেই নতুন করে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে পরিদর্শন কার্যক্রমে কোনো প্রভাব পড়বে না।’
এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, ‘বর্তমানে প্রযুক্তির যুগ, ফোনেও অনুমতি নেওয়ার সুযোগ আছে। তবে নতুন এ নিয়মের ফলে যদি কোনো বিরূপ প্রভাব হয়, তাহলে পরিবর্তন আনা হবে। এটাই চূড়ান্ত নয়।’