কালোটাকা সাদা করার বিপক্ষে ব্যবসায়ীরা

ইআরএফ ও আইসিএবি আয়োজিত আলোচনায় কালোটাকা সাদা করার বিপক্ষে অবস্থান নেন দেশের দুটি বড় ব্যবসায়ী সংগঠনের সভাপতি।

নিহাদ কবির, সভাপতি, এমসিসিআই

এবার ঢালাওভাবে কালোটাকা সাদা করার বিপক্ষে অবস্থান নিলেন দেশের দুটি বড় ব্যবসায়ী সংগঠনের সভাপতি। তাঁরা দুজন হলেন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি নিহাদ কবির ও ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রাহমান। তাঁরা ঢালাওভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগের সমালোচনা করে বলেন, সৎ ব্যবসায়ীরা সর্বোচ্চ হারে কর দেন। আর অনেকে চুরি-ডাকাতির টাকা ১০ শতাংশ হারে কর দিয়ে সাদা করে ফেলেন। এতে সৎ করদাতাদের প্রতি অন্যায় করা হয়। তাঁরা কর দিতে নিরুৎসাহিত হন।

অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) ও দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) যৌথ উদ্যোগে গতকাল মঙ্গলবার অনলাইনে আয়োজিত বাজেট আলোচনায় ওই দুই ব্যবসায়ী কালোটাকা সাদা করার বিপক্ষে মত দেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন আইসিএবির সাবেক সভাপতি হুমায়ূন কবির।

অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, আগামী বাজেট যেন গতানুগতিক না হয়। করোনা সংকট মোকাবিলাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়ার সুপারিশও করেন তাঁরা। বেশির ভাগ আলোচক বলেন, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির ‘মোহ’ থেকে বেরিয়ে এসে করোনা সংকট উত্তরণে স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা খাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বরাদ্দ দিতে হবে।

কালোটাকা প্রসঙ্গে এমসিসিআই সভাপতি নিহাদ কবির বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী প্রফুল্ল হয়ে বলেন, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ায় শিল্প খাত ভালো আছে। কিন্তু আমার তো ভালো লাগে না। নৈতিকভাবে ব্যবসা করে ৩০ বছর ধরে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ হারে কর দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু ১০ শতাংশ কর দিয়ে অনেকে পার পেয়ে যাচ্ছেন।’ নিহাদ কবির আরও বলেন, ‘দামি রেস্তোরাঁ ইজুমিতে কোন কোন ব্যবসায়ী খেতে গেলেন, তা চিন্তা না করলেও হবে। দেশের টাকা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছেন কারা, তাঁদের দিকে নজর দিন।’ এর আগে ইআরএফেরই এক অনুষ্ঠানে কর নিয়ে ব্যবসায়ীদের তীব্র সমালোচনার জবাবে সরকারের একজন উপমন্ত্রী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যবসায়ীদের দামি রেস্তোরাঁয় খাওয়ার প্রসঙ্গটি অবতারণা করেন।

অর্থমন্ত্রী প্রফুল্ল হয়ে বলেন, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ায় শিল্প খাত ভালো আছে। কিন্তু আমার তো ভালো লাগে না। নৈতিকভাবে ব্যবসা করে ৩০ বছর ধরে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ হারে কর দিয়ে যাচ্ছি।
নিহাদ কবির, সভাপতি, এমসিসিআই
আবুল কাশেম খান, সাবেক সভাপতি, ঢাকা চেম্বার

ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, ‘কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে অপ্রদর্শিত আয় ও অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থের মধ্যে পার্থক্য থাকা উচিত। চুরি-ডাকাতির টাকা ১০ শতাংশ কর দিয়ে সাদা করার সুযোগ দেওয়া মানব না। এতে সৎ করদাতারা বঞ্চিত হন।’

কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ায় সৎ করদাতারা কীভাবে নিরুৎসাহিত হতে পারেন, এর একটি উদাহরণ দেন রিজওয়ান রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা ৩২ শতাংশ হারে কর দিই। ব্যবসায়িক মনোভাব বিবেচনা করলে, আমি আগামী বছর আয়ের ৩২ শতাংশ হারে কর দেব না। কিন্তু পরের বছর ১০ শতাংশ কর দিয়ে ওই টাকা সাদা করে ফেলব। ২২ শতাংশ কম কর দিতে হবে, এটাই আমার লাভ।’

যুক্তরাজ্যে রেস্তোরাঁয় খেতে ভোক্তারা ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় পান। ছাড়ের টাকা সরকার দিয়ে দেয়। বাংলাদেশেও ভোক্তাদের ছাড় দেওয়া হলে ভোগে উৎসাহিত হবেন।
আবুল কাশেম খান, সাবেক সভাপতি, ঢাকা চেম্বার

একইভাবে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও এ কে খান গ্রুপের পরিচালক আবুল কাশেম খানও মনে করেন, ১০ শতাংশ হারে কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে সৎ করদাতাদের প্রতি অন্যায় করা হয়।

ব্যবসায়ীদের প্রতি একমত পোষণ করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। তাঁর মতে, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে নিয়মিত করদাতাদের কর প্রদানে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ১২ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে।

চলতি বাজেটে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের পাশাপাশি নগদ টাকা, ব্যাংকে গচ্ছিত কালোটাকাও ১০ শতাংশ কর দিয়ে সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। এলাকাভেদে আয়তন অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিয়ে জমি-ফ্ল্যাট কিনেও কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রয়েছে। কেউ কালো টাকা সাদা করলে এনবিআর ছাড়াও দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) কোনো সংস্থা টাকার উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করতে পারবে না।

করপোরেট কর কমানোর দাবি

রূপালী চৌধুরী, সভাপতি, এফআইসিসিআই
প্রথম বছরেই লাভ হবে, এর নিশ্চয়তা নেই। ব্যবসায় ‘না লাভ, না লোকসান বা ব্রেক ইভেনে’ যেতেও কয়েক বছর সময় লাগে। প্রথম বছর থেকে কর দিতে হলে কে ব্যবসা করতে আসবে?
রূপালী চৌধুরী, সভাপতি, এফআইসিসিআই

অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদেরা করপোরেট কর কমিয়ে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার তাগিদ দেন। আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) সাবেক সভাপতি আফতাব উল ইসলাম বলেন, এত করপোরেট কর দিয়ে ব্যবসা করা কঠিন। করহার এত বেশি হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এ দেশে আসবেন না। এ ছাড়া এ দেশে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও তালিকাভুক্ত নয় এমন প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও করহারের পার্থক্য কম। এটিও বড় বাধা।

অন্তত পাঁচ বছর একই করহার রাখতে হবে বলে মনে করেন তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান। তিনি বলেন, পাঁচ-দশ বছর করহার এক থাকলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা আসবে। তাঁরা বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন।

কোনো প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক লেনদেন তিন কোটি টাকার বেশি হলে লাভ-ক্ষতিনির্বিশেষে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। এ নিয়ে আপত্তি করেন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) সভাপতি রূপালী চৌধুরী। তিনি বলেন, প্রথম বছরেই লাভ হবে, এর নিশ্চয়তা নেই। ব্যবসায় ‘না লাভ, না লোকসান বা ব্রেক ইভেনে’ যেতেও কয়েক বছর সময় লাগে। প্রথম বছর থেকে কর দিতে হলে কে ব্যবসা করবে?’

করহার কমানোর বিষয়ে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান বলেন, কর কমানোর ফলে বিনিয়োগ বেড়েছে কি না, তা দেখা দরকার। তিনি মনে করেন, আস্থার ঘাটতি থাকলে বিনিয়োগ কমবে। ব্যাংক খাত ও কর প্রশাসনের সংস্কার নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হতে পারে।

ভোক্তার খরচ বাড়াতে হবে

করোনাকালে কীভাবে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে হবে, বিষয়টিও আলোচনায় আসে। বক্তারা বলেন, ভোক্তার খরচ করার সামর্থ্য বাড়াতে পারলে পণ্য বা সেবার চাহিদা বাড়বে। যা উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করবে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য টিকে থাকবে।

ভোক্তা খরচ করলে প্রণোদনা বা ছাড় দেওয়ার সুপারিশ করেন ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যে রেস্তোরাঁয় খেতে ভোক্তারা ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় পান। ছাড়ের টাকা সরকার দিয়ে দেয়। বাংলাদেশেও ভোক্তাদের ছাড় দেওয়া হলে ভোগে উৎসাহিত হবেন।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ উদ্বেগজনক বলে মনে করেন গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, শ্রমজীবী ও শহুরে গরিবদের প্রণোদনা দিতে হবে। তাঁরা সবচেয়ে বেশি ভুগছেন।

পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাশুরুর রিয়াজ বলেন, আগামী এক বছরে যদি ৫০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে না পারি, তবে পুনরুদ্ধার কার্যক্রম ‘শূন্য’ থেকে শুরু করতে হবে।

প্রবৃদ্ধির মোহ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে

অনুষ্ঠানের শুরুতেই প্রথম আলোর বিশেষ বার্তা সম্পাদক শওকত হোসেন আগামী বাজেটের অগ্রাধিকারের বিষয় নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই না আগামী বাজেটে জিডিপি নিয়ে আলোচনা হোক। আগামী বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি মোটেও মূল বিষয় হতে পারে না। আগামী বাজেটে উৎপাদন, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও ভোক্তা চাহিদাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।’

সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমানও জিডিপির প্রবৃদ্ধির মোহ থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, আগামী বাজেটে করোনা সংকট মোকাবিলাকেই প্রাধান্য দিতে হবে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, জিডিপিকে প্রাধান্য না দিয়ে করোনায় সংকটে পড়া মানুষকে প্রাধান্য দিতে হবে। আগামী বাজেটে জীবন ও জীবিকায় বড় বরাদ্দ রাখতে হবে।